Sister Nivedita :মৃত্যু যখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, কী বলেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা? কেমন ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিনটা?

0
2137

দেশের সময়: দার্জিলিংয়ে এসেছেন নিবেদিতা। উঠেছেন লেবং কার্ট রোডে। রায় ভিলায় বসু দম্পতির কাছে। বাড়িটি অবলাদেবীর বড় বোন সরলাদেবী ও ভগ্নিপতি দ্বারকানাথ রায়ের। প্রথম কয়েকদিন সবাই মিলে আনন্দে কাটল। জগদীশচন্দ্র বসু সান্দাকফু যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। রাজি হয়ে গেলেন নিবেদিতা। বললেন, ‘ওখানে একটি মঠ আছে। দেখব।’ চিঠিতে মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস এস কে রেডক্লিপকে জানালেন সেকথা।

সান্দাকফু যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় জিন কষা হল। বিছানা বাঁধা হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবারদাবার তৈরি।হঠাৎই ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন ভগিনী। ঠিক হল, যাত্রা কয়েকদিন পিছিয়ে দেওয়া হবে। আগে নিবেদিতার শরীর ঠিক হোক। কিন্তু ক্রমেই বাড়তে থাকল অসুস্থতা। ভগিনীর প্রচণ্ড জ্বর, সঙ্গে রক্ত আমাশয়।চিকিৎসক নীলরতন সরকার তখন দার্জিলিংয়ে।

খবর দেওয়া হল তাঁকে। এলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল চিকিৎসা। কিন্তু ডাক্তারবাবু হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, ‘এ লড়াই জেতা সম্ভব নয়।’ নিবেদিতার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন বসু দম্পতি। তাঁরা ঠিক করলেন, নিবেদিতাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন।নিষেধ করলেন চিকিৎসক। বললেন, ‘এত দূরের রাস্তা। শরীরে হয়তো ধকল সইবে না।’ ফলে রায় ভিলাতেই চলতে থাকল চিকিৎসা।


দিনটা ৩ অক্টোবর, ১৯১১। রোগশয্যা থেকেই বোন উইলসনকে চিঠি লিখলেন ভগিনী। সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু তখনও দৃপ্ত ব্যক্তিত্বশালিনী তিনি। কেউ তাঁর ঘরে এলে স্মিত হাসিতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। সহজে নিজের কষ্টের কথা, অসুখের কথা বলতে চান না। বরং তাঁর মুখে শোনা যায় আরও কাজের পরিকল্পনা। বলেন, বাগবাজারের স্কুলের কথা।


৭ অক্টোবর। নিবেদিতার ইচ্ছায় উকিল ডাকা হল। তৈরি হল উইল। নিজের যা কিছু সঞ্চিত অর্থ, গ্রন্থস্বত্ব থেকে আয়, চিরস্থায়ী তহবিল হিসেবে তুলে দিলেন তাঁর স্কুলকে। লক্ষ্য, নারী শিক্ষার প্রসার। তহবিলের অর্থ থাকল বেলুড় মঠের ট্রাস্টির তত্ত্বাবধানে। উইলে শর্ত রাখলেন ভগিনী। বিদেশি শাসকদের সঙ্গে এই বিদ্যালয়ের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। তাদের কাছ থেকে বিদ্যালয়ের জন্য কোনও সাহায্য নেওয়া হবে না। নিবেদিতা যেন নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন। এবার তিনি চলে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত।

এক একটা দিন কাটছে। অবলাদেবীকে ভগিনী বলছেন, ‘আমার শেষ সময় উপস্থিত।’ আর তা শুনেই বসু দম্পতির আশ্বাস, ‘চিন্তা কোরো না। সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি। এই অসুখ মোটেই মারাত্মক নয়।’ কিন্তু মনে মনে তাঁরাও প্রমাদ গুনছিলেন।নিবেদিতা যা পড়তে বা শুনতে ভালোবাসেন, তা পড়ে শোনাচ্ছেন জগদীশচন্দ্র।
শেষ সন্ধ্যায় পাঠ চলছিল রায় ভিলায়।

অসুস্থ ভগিনীর আবেগতাড়িত মন আলোড়িত হতে পারে ভেবে জগদীশচন্দ্র সেদিন কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে পড়েন। কিন্তু মৃত্যুশয্যাতেও নিবেদিতার মস্তিস্ক পুরোমাত্রায় সজাগ।বিষয়টি ধরে ফেললেন তিনি।ফলে জগদীশচন্দ্রকে পুরোটা পড়তে হল। দার্জিলিংয়ে আসার কয়েকমাস আগে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের একটি প্রার্থনা বাণী ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নিবেদিতা।এমনকী সেটি ছেপে পরিচিতদের মধ্যে বিলিও করেন। নিবেদিতার অনুরোধে সেই প্রার্থনা বাণীটি পাঠ করে শোনান অবলাদেবী।

পড়া শেষ হলে নিবেদিতা উচ্চারণ করেন উপনিষদের দিব্যবাণী। অমনি দীপ্ত হয়ে ওঠে তাঁর মুখমণ্ডল। অবলাদেবী বারবার জিজ্ঞাসা করায় ক্ষীণ কন্ঠে নিবেদিতা জানান, ‘বড্ড ক্লান্ত লাগছে।’ তারপর অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করে বলেন, ‘নৌকা ডুবছে। আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব।’ সেই রাতে নিবেদিতাকে খাওয়ানো গেল না। ওষুধও খেলেন না। সরিয়ে দিলেন অক্সিজেনের নলটা। চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তিনি।


১৩ অক্টোবর, শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাতটা।কারও মুখে কোনও কথা নেই। গত কয়েকদিন ধরেই দার্জিলিংয়ের আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। কিন্তু আজ সকালটা বড় সুন্দর। ঝকঝকে সোনা রোদ গায়ে মেখে চিকচিক করছে চিরতুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। জানলা দিয়ে একফালি রোদ ঢুকল নিবেদিতার ঘরে। রবি রশ্মির সেই মধুর স্পর্শ অসুস্থ ভগিনীর বিষন্ন মনে যেন খুশি এনে দিল। তার পর চিরতরে চোখ বুজলেন তিনি। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে (১৮৬৭-১৯১১)।


দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল নিবেদিতার মৃত্যুসংবাদ। পুজোর ছুটিতে অনেকেই পাহাড়ে বেড়াতে এসেছিলেন। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে এলেন সবাই। রায় ভিলার সামনে উপচে পড়ল ভিড়। বেলা দু’টোর সময় শুরু হল শেষযাত্রা। হাজার হাজার মানুষ শামিল হয়েছেন।শ্মশানভূমিতে পৌঁছতে বেজে গেল বিকেল চারটে। সবাই নতমস্তক। রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছিলেন। তিনি মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। যে বাড়িতে নিবেদিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেটি আজও দার্জিলিংয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। বর্তমান রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সংরক্ষিত হয়েছে বাড়িটি।

দেখভালের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে। স্বামী নিত্যসত্যানন্দ তথা বিশ্বরূপ মহারাজের হাত ধরে ওই বাড়িতে পাহাড়ের গরিব ছেলেমেয়ে ও মহিলাদের জন্য চালু হয়েছে বহুমুখী কর্মপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র। চাকরির পরীক্ষার কোচিং। কয়েকমাস হল স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ প্রয়াত। তাঁর জায়গায় নতুন মহারাজ দায়িত্বভার নিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বরূপ মহারাজ নিবেদিতার স্মৃতি বিজড়িত রায়ভিলাকে পাহাড়ের অন্যতম একটি দ্রষ্টব্য করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আপ্রাণ।


ঐতিহাসিক এই বাড়িটির জীবনকথা রোমাঞ্চকর। বহু ঘটনার সাক্ষী। আর সে শুধু রায় ভিলা কেন, দার্জিলিং শহরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ভগিনীর কাজকর্মের নানা নিদর্শন। তাঁর প্রিয় শহর দার্জিলিংয়ে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন নিবেদিতা।কখনও অবসর যাপনের জন্য। কখনও আবার ‘কুইন অফ হিলস’ হয়ে উঠেছিল তাঁর আরোগ্যের আশ্রয়স্থল।দার্জিলংয়ে বসে চোখের আয়নায় পাহাড়ি প্রকৃতির মুগ্ধতা নিয়ে বোন উইলসনকে চিঠিও লিখেছেন।


দার্জিলিংয়ের বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি প্রকৃতির মতোই নিবেদিতার কাজের বহুমুখী প্রকাশ ছড়িয়ে রয়েছে শৈলশহরের পথের বাঁকে। দার্জিলিংয়ে ঘুরতে এসেও কর্মব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। কখনও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সঙ্গে নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন, কখনও বা জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা গ্রন্থের প্রুফ দেখেছেন। ছুটে গিয়েছেন পাহাড়ি বস্তির শিশুদের কাছে। কখনও আবার আপন খেয়ালে ঘুরেছেন পাহাড়ি গ্রামের পথে পথে, নেপালি-ভুটিয়া বস্তিতে।পাহাড়ের বাসিন্দাদের সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি, ‘এরা সকলেই সাহসী, পরিশ্রমী আর ধর্মপ্রাণ।’


সালটা ১৮৯৮। এপ্রিল মাস। বিবেকানন্দ তখন দার্জিলিংয়ে। মিস মুলারের সঙ্গে পাহাড়ে যাওয়ার কথা নিবেদিতারও। স্বামীজি হঠাৎ টেলিগ্রাম করে তাঁকে আসতে নিষেধ করলেন। মন খারাপ হয়ে গেল ভগিনীর। ফের অপেক্ষা। প্রথমবার তাঁর দার্জিলিংয়ে যাওয়ার সুযোগ এল ১৯০৩ সালে, মে মাসে।পাহাড়ে পৌঁছে নিবেদিতার ঠিকানা হল ঘুম স্টেশনের কাছে অ্যাসাইলিন ভিলা।কিছুদিন আগেই দার্জিলিংয়ে এসেছেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু। এবার ৪৯ দিন পাহাড়ে ছিলেন নিবেদিতা। তখন গোপালকৃষ্ণ গোখলেও দার্জিলিংয়ে। মাঝে একদিন ভগিনীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

বড়দিনে স্কুল ছুটি থাকবে। সেসময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯ তম অধিবেশন বসবে মাদ্রাজে।নিবেদিতার কাছে গোখলে জানতে চাইলেন, ‘আপনি যাচ্ছেন তো?’ একইসঙ্গে ভগিনীকে তাঁর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, ‘কংগ্রেস থেকে আপনি দূরে সরে আছেন কেন?’ কথাটা শুনে আশ্বস্ত করলেন নিবেদিতা। বললেন, ‘কংগ্রেসে সক্রিয় যোগদান না করলেও বিশ্বাস করুন কংগ্রেস আমার চিন্তার বাইরে নয়।’


ওই বছরেরই আগস্টের মাঝামাঝি বসু দম্পতির সঙ্গে ফের দার্জিলিংয়ে এসেছিলেন নিবেদিতা। সেসময় জগদীশচন্দ্রের গবেষণা গ্রন্থ তৈরির কাজে সাহায্য করেছিলেন। পাশাপাশি সেরেছিলেন তাঁর ‘ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও।পাহাড়ে বসেই তিনি গ্রন্থের ছ’টি অধ্যায়ের কাজ শেষ করেন। ১৯০৫ সালের মার্চে ব্রেন ফিভারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ভগিনী। দীর্ঘ একমাসের অসুস্থতায় তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছিল। কিছুটা সুস্থ হলে চিকিৎসক নীলরতন সরকারের পরামর্শে নিবেদিতাকে পাহাড়ে নিয়ে এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু।

এই সফরে তাঁদের সঙ্গী ছিলেন নিবেদিতার বোন ক্রিস্টিন। মানসিকভাবে ভগিনীকে উৎফুল্ল রাখার জন্য সদা তৎপর জগদীশচন্দ্র। কী করবেন ভেবে পান না। দেখলেন, দার্জিলিংয়ের বাজারে বিক্রির জন্য একজন একটি শেয়ালছানা নিয়ে এসেছেন কেউ। চার আনা দিয়ে সেটি কিনে নিলেন জগদীশচন্দ্র। বাড়ি ফিরে সেটি দিলেন নিবেদিতাকে। উপহার পেয়ে ভগিনীর আনন্দ যেন আর ধরে না। আদর করে শেয়ালছানাটির নাম দিলেন ওয়াইল্ড হার্ট। তাকে নিয়েই সময় কাটাতে থাকলেন। এসব দেখে মজা করে জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ওই শেয়ালছানার উপর অত মনোযোগ দিলে তো মুশকিল।ও-ই তো দেখছি আমায় ফতুর করবে।’ এর পর একদিন সকালে অভিমানের সুর ঝরে পড়ে নিবেদিতার গলায়। বলেন, ‘কাজ করতে পারব এবার।

আজ বিকেলে শেয়ালছানাটিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব।’
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর।বঙ্গবিভাজন ঘোষিত হল।প্রতিবাদে উত্তাল কলকাতা সহ গোটা দেশ। কলকাতার পথেঘাটে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরে পালিত হল রাখিবন্ধন। নেতৃত্ব দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিবেদিতা তখন দার্জিলিংয়ে। সেখানেই ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে টাউন হলের জনসভায় বক্তৃতামঞ্চে হাজির হলেন নিবেদিতা। সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।

দার্জিলিংয়ের মাটিতে মিশে আছে নিবেদিতার চিতাভস্ম।দার্জিলিং স্টেশন থেকে একটু নীচেই, জায়গাটির নাম মুর্দাহাটি। এখানেই শ্মশান।প্রখ্যাত লেখক তথা ভাষাবিদ রাহুল সংকৃত্যায়নের সমাধিও রয়েছে এখানে। তার পাশেই নিবেদিতার স্মৃতি সৌধ।নিবেদিতার চিতাভস্ম চারভাগ করা হয়। একভাগ রাখা হয় দার্জিলিংয়ে। একভাগ পাঠানো হয় বেলুড়ে। একভাগ যায় বোস ইনস্টিটিউটে। আর একভাগ নিবেদিতার জন্মস্থান আয়ারল্যান্ডে। তবে প্রয়াণের শতবর্ষ পার করে এসে ভগিনীর সমাধিক্ষেত্র তথা স্মৃতিসৌধ আজ অনাদরে। বদলে যাওয়া পাহাড়ে গুমরে কাঁদছে ইতিহাস। আক্ষেপ এটুকুই!

Previous articleBlue Tea: গাইঘাটার গ্রামে অপরাজিতা ফুল দিয়ে তৈরী ‘নীল চা’ বাংলায় এখন খ্যাতির শীর্ষে – দেখুন ভিডিও
Next articleDigital News Media: ডিজিটাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্র সরকার,আইন পাশ হতে চলেছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here