দেশের সময়: কাংড়ি চেনেন তো! কৃষ্ণবর্ণের। দাঁড়াওয়ালা জলজ জীব। চেনেন। কারণ, আধুনিককালে তারই নাম হয়েছে কাঁকড়া। যাকে ঘিরে রয়ে গিয়েছে জানা অজানা নানা গল্প। বঙ্গসমাজ কাঁকড়াকে রীতিমতো মহাকাব্যে উত্তীর্ণ করেছে।এককথায় বলতে গেলে খাদ্যরসিক প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে একটি কুচুটে কাংড়ি বিদ্যমান।

ঘি, গরমমশলা আর লঙ্কা দিয়ে লাল টুকটুকে কাঁকড়ার ঝোল ঠিক কতদিন আগে খেয়েছেন মনে পড়ে? কিংবা বর্ষার দুপুরের মেনুতে যদি থাকে সুন্দরবনের স্পেশাল পিঁয়াজের চাটনির সঙ্গে কাঁকড়া পোড়া। কেমন হয়! লঙ্কার আচারের সঙ্গে চিজে মাখোমাখো কাঁকড়াও কিন্তু স্বাদে আর সবাইকে দশ গোল দিতে পারে। মনে পড়ে, শীতকালে খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার পর উনুনে যে নিভু নিভু আগুন থাকত, তার ভিতর হাত-পা বেঁধে কাঁকড়া ফেলে দেওয়া। তারপর সেই কাঁকড়া পুড়ে নরম হলে খোলস ছাড়িয়ে নুন, তেল, কাঁচালঙ্কা, পিঁয়াজ দিয়ে মেখে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়া, সত্যি জিভে লেগে থাকত।
প্রাবন্ধিক রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একবার লিখেছিলেন, বাটিভরা কাঁকড়ার ঝোল দেখেই নাকি বাঙালির জিভ লকলক আর নোলা সকসক করে।

এককথায় বলতে গেলে, বাঙালি যেসব খাবার রসিয়ে কসিয়ে খেতে পছন্দ করে, তার মধ্যে অন্যতম কাঁকড়া।কাঁকড়ার শক্ত খোলসের ভিতর নরম তুলতুলে স্বাদু মাংসের স্বাদই আলাদা। খেতে সামান্য ঝক্কি পোহাতে হয় ঠিকই। কিন্তু তা বলে মোটেই হাতগুটিয়ে বসে থাকা নয়।কাঁকড়ার তেল-ঝাল রান্নাঘরে টেক্কা দিতে পারে চিংড়ি মাছের মালাইকারিকেও। আর কাঁকড়ায় যদি থাকে মাখনের আদর, গোলমরিচের ভালবাসা-আহা!


কাঁকড়ার আর এক নাম দশরথ। অনেকে বলে থাকেন, যাত্রাকালে অলুক্ষণে কাঁকড়ার নাম নিতে নেই। সঙ্গে কাঁকড়া থাকলে তাই তাকে এভাবে স্মরণ করতে হয়, দশরথের ঝোড়াটা নিয়েছ তো? রুই, কাতলা, চিংড়ি, ইলিশ কাউকেই অবশ্য এমন রামায়ণী নামে ডাকা হয় না।
সাহিত্যে তো ঘুরে ফিরে এসেছে কাঁকড়া কাহিনী।রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ গল্পের কথা মনে আছে! কানাই বাজার থেকে ডিমভরা কাঁকড়া এনে লাউডগা দিয়ে রেঁধে পুপুদিদিকে সন্তুষ্ট করেছিল।কিংবা ‘পথের পাঁচালি’তে দুগ্গা মাছ কাটতে কাটতে গোকুলের বৌকে যখন প্রশ্ন করে, হ্যাঁ, খুড়িমা, কাঁকড়া কোথায় পেলে। এ কি খায়!খুড়িমা উত্তর দেয়, বিধু জেলেনি বলে গেল সবাই খায়। তাই কিনলুম। ওই এতগুলো পাঁচ পয়সায় দিয়েচে।
এটা ঠিক যে, কাঁকড়া শুধু সুস্বাদু নয়। মাগ্গিগন্ডার বাজারে সস্তাও ছিল বটে।


বর্ষা এলেই ঝরনার জলের সঙ্গে ডুয়ার্সে
পাহাড়ি ঝোড়ায় দেখা মেলে তাদের। সেসব লালচে ছোট কাঁকড়ার ওজন ৫০-৬০ গ্রাম। খেতেও দারুণ সুস্বাদু। চা বাগানে সান্ধ্য হাটে জাল দিয়ে ঘেরা ঝুড়ির মধ্যে দেখা মেলে তাদের। জঙ্গলে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভীষণ পছন্দের। আর সুন্দরবনের হাজার হাজার মানুষের তো দিন-রাত কাটে কাঁকড়ার সঙ্গেই। খাঁড়ি, নদীতে কাঁকড়া ধরেই তাঁদের পেট চলে। বেশ কয়েকটি হাত ঘুরে সেই কাঁকড়া চলে যায় বিদেশে। বড় ক্রেতা চীন। তবে তাইল্যান্ড, ব্যাঙ্কক, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরেও সুন্দরবনের কাঁকড়ার ভালোই চাহিদা।দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, ঝড়খালিতে কাঁকড়ার আড়ত রয়েছে।কাঁকড়া ধরার জন্য নানা ধরনের জাল ও ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। তার পর ভিজে চটের থলে ও বাঁশের ঝুড়িতে তাজা কাঁকড়া পাঠানো হয় আড়তে। সেখানেই হয় গ্রেডিং। প্যাকিং।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু হার্ট কিংবা ব্রেন নয়, ব্যক্তিত্বে উগ্র আচরণ কমাতে পারে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। সব সামুদ্রিক মাছেই সেলেনিয়াম থাকে। তবে কাঁকড়ায় এর পরিমাণ অনেক বেশি। সেলেনিয়াম আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। থাইরয়েড হরমোন ঠিক রাখে।কাঁকড়া প্রোটিনের একটি বড় উৎস। এতে রয়েছে ভিটামিন বি, ফ্যাটি অ্যাসিড, রাইবোফ্লাবিন, নিয়াসিন, আয়রণ, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম ও ফসফরাস।

আর্থারাইটিস, অ্যালঝাইমার্স, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ওবেসিটি প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে আপনি ডায়েটে যোগ করতেই পারেন কাঁকড়া। তবে যাঁরা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন কিংবা কোলেস্টেরলের ঝুঁকি রয়েছে, তাঁদের কাঁকড়া খাওয়া উচিত নয়। অনেকের আবার কাঁকড়া খেলে অ্যালার্জি হতে পারে। ফলে জিভে জল এলেও কাঁকড়া খাওয়ার আগে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


বিশ্বব্যাপী চাহিদা এর। তবে প্রকৃতিতে পাওয়া কাঁকড়ার সংখ্যা ক্রমেই কমে আসায় ইদানীংকালে ম্যানগ্রোভ এলাকায় কাঁকড়ার চাষ অনেক বেড়েছে। জোয়ারভাটার নদী বা সমুদ্রের উপকূল থেকে সংগ্রহ করা হয় কাঁকড়ার পোনা। চিংড়ি খামার কিংবা ঘেরগুলিতে অনেকে কাঁকড়ার সঙ্গেই চিংড়ি, মিল্কফিশেরও চাষ করছেন। জাপান হ্যাচারিতে নীল কাঁকড়া চাষ করছে। মূলত কাঁকড়া ধরা হয় অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোটালে। তবে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় তার দু’দিন আগে থেকেই। এক একটি দল একবারে কয়েক লক্ষ টাকার কাঁকড়া ধরে। কিন্তু সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মতো কাঁকড়ার খোঁজে যাওয়া দলকেও প্রাণ হাতে করেই বেরতে হয় বাড়ি থেকে। কাঁকড়া ধরতে গিয়ে সুন্দরবনের কতজন যে বাঘের পেটে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু কি বাঘ! কুমির, বিষধর সাপের ভয়ও তো রয়েছে।

সুন্দরবনে যাঁরা দূরের জঙ্গলে, নদীর পাড়ে কাঁকড়া ধরতে যান, স্থানীয় ভাষায় তাঁদের চাপান বলে। ওই দলের সঙ্গে দশ-বারোদিনের খাবার থাকে। থাকে কাঁকড়া ধরার চার। চার হিসেবে কখনও থাকে সোনা ব্যাঙ। কখনও আবার মাছ। টুকরো টুকরো করে কেটে নেওয়া হয় সেগুলো। চার সংরক্ষণের জন্য নুন। যাত্রার আগের দিন দলের সবাই নিরামিষ খান।চার হিসেবে মাছের মধ্যে থাকে ট্যাংরা কিংবা কামট।কামট মাছের চারে বেশি কাঁকড়া ধরা পড়ে।
সুন্দরবনে প্রায় এক লক্ষ মৎস্যজীবী কাঁকড়ার উপর নির্ভরশীল। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুন-জুলাই কাঁকড়ার প্রজননকাল।

এসময় ডিম থেকে কাঁকড়ার জন্ম হয়। তারপর জলে ভেসে এসে তারা আশ্রয় নেয় নদীর পাড়ে, মাছের ঘেরে। চাষিদের কেউ কেউ ছোট পুকুরে কাঁকড়াকে মোটা তাজা করেন। কেউ আবার বড় ঘেরে বা চৌবাচ্চায় চিংড়ির সঙ্গে চাষ করে থাকেন কাঁকড়া। অনেকে উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে কাঁকড়া চাষ করেন। খাবার হিসেবে দিয়ে থাকেন ছোট মাছ, কুচে, শামুকের মাংস। আমাদের দেশে ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১১টি প্রজাতি সামুদ্রিক। শীলা ও সাঁতারো প্রজাতির কাঁকড়া মূলত রপ্তানি হয়। জীবন্ত এবং হিমায়িত দু’ভাবেই হয়ে থাকে কাঁকড়ার বিদেশযাত্রা।

গর্ততাড়া পদ্ধতিতে মূলত শীতকালে কাঁকড়া ধরা হয়। এই সময় কাঁকড়া গর্ত থেকে বের হতে চায় না। তখন কাঁকড়া ধরতে পঞ্চমীর দিন যাত্রা শুরু করতে হয়। পঞ্চমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত কাঁকড়া ধরা যায়। এই সময় জোয়ারে নদীর জল উপকূলে কম ওঠে। উপকূলে গর্তের আশপাশে পায়ের ছাপ দেখেই শিকারিরা কাঁকড়ার উপস্থিতি টের পান। বাঁকানো লোহার শিক ঢুকিয়ে দেন গর্তের মধ্যে।কাঁকড়া কামড়ে ধরে সেই শিক। তার পর সেটি বেয়ে উঠে আসে উপরে।

সুন্দরবনে মূলত তিন ধরনের পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরা হয়। দন পদ্ধতি, থবগা সুত পদ্ধতি ও গর্ততাড়া পদ্ধতি। থবগা সুত ও দন পদ্ধতিতে কোটালের সময় জোয়ারের জলে কাঁকড়া ধরা হয়। গর্ততাড়া পদ্ধতি আলাদা। মরানি অর্থাৎ যখন জোয়ারের জল নদীর উপকূলে কম ওঠে, তখন এই পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরা হয়।

প্রাণী বিজ্ঞানীরা কাঁকড়াকে বলে থাকেন, ক্রাস্টেসিয়ান।কাঁকড়াকে আর্থ্রোপডা নামেও ডাকা হয়। মিষ্টি জল আর সমুদ্র মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার জাতের কাঁকড়া রয়েছে। কিছু প্রজাতি ডাঙায় বাস করলেও বেশিরভাগই জলে থাকে। জলের শ্যাওলা থেকে বিভিন্ন গাছের পাতা, সবকিছু খায়। এমনকী ফেলে দেওয়া খাবারও। অনেক সময় বড় শামুকের সঙ্গে বাস করে। ভাগাভাগি করে খাবার খায়। অন্যদিকে, ম্যানগ্রোভ অরণ্য ঘেরা দ্বীপ এলাকায় কিংবা উপকূলে বাঘ থেকে বুনো শুয়োর, শিয়াল, কুমির, পাখি ও মাছেদের অন্যতম খাদ্য কাঁকড়া।
জাপানের সমুদ্রে দৈত্যাকার কাঁকড়া দেখা যায়। সমুদ্রে মাকড়সা-কাঁকড়া পাওয়া যায়। তারা জলের আগাছা দিয়ে নিজেদের আড়াল করে।প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে পাওয়া যায় চোর-কাঁকড়া।প্রায় সব ধরনের কাঁকড়ার জন্ম হয় ডিম ফুটে। কাঁকড়ার বাচ্চাদের বিজ্ঞানীরা জোইয়া বলে ডাকেন। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত কাঁকড়া অনেকবার খোলস পাল্টায়।কাঁকড়া যখনই খোলস ছাড়ে গোপন জায়গায় চলে যায়। আর একবার খোলস ছাড়লে ওজন বেড়ে হয় দ্বিগুণ। আস্তে আস্তে পা তৈরি হয়। ধারালো হয় দাঁড়া। প্রকৃতিতে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য গড়ে ওঠে শরীর। এদের প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে এরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়। ৩০০-৬০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে পারে এক একটি কাঁকড়ার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here