দেশের সময়,পেট্রাপোল: পণ্য খালাসের জন্য শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়া ঘিরে বিতর্ক। তার জেরে সোমবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে পণ্যের আমদানি রফতানি। গোটা ঘটনায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে রফতানিকারক সংস্থা এবং পণ্য খালাসকারী সংস্থার সংগঠনগুলি।

কোনও পণ্যবোঝাই ট্রাক পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে সেন্ট্রাল ওয়ারহাউসিং কর্পোরেশন (CWC)-এর গুদামে যায়। সেখান থেকে ট্রাক থেকে পণ্য খালাস হয় বা ট্রাকে বোঝাই হয়। ওই কাজ করেন শ্রমিকরা। অভিযোগ, সোমবার সকাল থেকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বিএসএফ শ্রমিকদের সিডাব্লিউসি (CWC) পার্কিংয়ের মধ্যে ঢুকতে দিচ্ছে না। তার জেরে আমদানি এবং রফতানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।

পেট্রাপোলে আন্দোলনের জেরে মঙ্গলবারও বন্ধ আমদানি-রপ্তানি 

স্থানীয় এক রফতানিকারক জানানন, ‘‘পার্কিংয়ে তাঁদের লোকজনকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যার ফলে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে আমদানি এবং রফতানিও বন্ধ। একটি গাড়ি বাংলাদেশে ঢোকার সময় অনেক রকম কাজ আছে। সেই কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এলপিআই ম্যানেজার সেটা বন্ধ করেছেন। তাঁর নির্দেশে বিএসএফ শ্রমিকদের ঢুকতে দিচ্ছে না।’’

একই অভিযোগ করছেন পণ্য খালাসকারী এজেন্টদের সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘পণ্য খালাস এবং বোঝাই করা যাঁদের দায়িত্ব তাঁদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ফলে আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর জন্য সরকারি আধিকারিকদের অযোগ্যতাই দায়ী।’’

বিএসএফ (BSF) পেট্রাপোল (Petrapole) আইসিপিতে ঢুকতে বাধা পরিবহণ কর্মীদের। ফলে সমস্যা হচ্ছে বাণিজ্যের কাজে। পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের আইসিপিতে ঢুকতে দেওয়ার দাবিতে সোমবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দেয় বনগাঁও ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন। ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য, পেট্রাপোল আইসিপির প্রায় শতাধিক কর্মী আছেন।

ইউনিক কার্ড ছাড়া কোনও পরিবহন কর্মীকে আইসিপির মধ্যে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মীদের। এই কারণে সোমবার থেকে পেট্রাপোলে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করে পরিবহণ সহ পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। মঙ্গলবারও তাঁদের আন্দোলন চলছে ফলে ব্যাহত আমদানি ও রপ্তানি।

বিক্ষোভকারিদের দাবি
বিক্ষোভকারিদের দাবি নতুন কার্ড তৈরি না হওয়া পর্যন্ত পুরনো নিয়মে তাঁদের আইসিপিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হোক। দাবি না মেনে নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আইসিপি-পেট্রাপোলে একাধিক চোরাচালানের ঘটনা ঘটেছে সেই সব নজরে আসতেই , বিএসএফ তাঁদের নজরদারি এবং সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে।  

বিশেষ তথ্য সূত্রে জানতে পারা গেছে, কিছুট্রাক ড্রাইভার যারা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করে তারা আন্তঃসীমান্ত অপরাধ যেমন সোনা, রূপা, ফেনসিডিল সিরাপ, মাদক ইত্যাদি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এবং ধরাও পড়েছে বেশ কিছু অসাধু ড্রাইভার৷

তার ফলস্বরূপ, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২-এ, বিএসএফ আইসিপি-পেট্রাপোলের মাধ্যমে সড়কপথে রপ্তানি ও আমদানিতে নিয়োজিত ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা তদন্ত শুরু করেছে।  বিএসএফ চালকদের কাছ থেকে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স  পেয়ে ৫২ টি ড্রাইভিং লাইসেন্স  বাজেয়াপ্ত করেছে ইতি মধ্যেই ৷  

এর পর, ১৭ জানুয়ারি, ২০২২-এ আবারও ৩০ জন ট্রাক চালকের জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গেছেবিএসএফ সূত্রে।  সেই অনুযায়ী, বিএসএফ মোট ৮২টি জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স কাস্টমস বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছে।  

ভারতীয় কাস্টমস এবং ল্যান্ড পোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে যে যেসব ট্রাকের চালকের জাল লাইসেন্স পাওয়া যাবে তাঁদের বিএসএফ বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারবে না।
বিএসএফ সাফ জানিয়েছে, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালককে কোনও ভাবেই বাংলাদেশে যেতে দেওয়া যাবে না কারণ এই ধরনের চালকরা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভিত্তিতে শুল্ক বিভাগ থেকে  গাড়ির পাস নেয়,  যার ভিত্তিতে বিএসএফ ট্রাকগুলিকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়।  ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য, বিএসএফ বনগাঁ ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনকে একটি স্থায়ী অপারেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছে যাতে দেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের সঙ্গে আপস করা না হয়।

যে কারণে বিএসএফ আইসিপিতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে
বিএসএফ আইসিপি-পেট্রাপোলের সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ ঠেকাতে  অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।  সম্প্রতি, ০৪ জানুয়ারী, ২০২২-এ,  বিএসএফ একজন পরিবহণকারীর কাছ থেকে ১,৪৪,২২,৩৫৬/- টাকা মূল্যের সোনা উদ্ধার করেছিল, যখন আইসিপি পেট্রাপোলে পাচার নিরাপত্তা কর্ডন থেকে একটি বাইকে সেগুলি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।  পরে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা একটি ট্রাকের ভিতরে লুকিয়ে রেখে এই সোনা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়।  একই রকম ভাবে ১৯ জুলাই, ২০২১-এ, যখন বাংলাদেশ থেকে আগত ভারতীয় ড্রাইভারের কাছ থেকে বিএসএফ কর্তৃক ১,৭১,৮০,৪২০/- টাকার সোনা উদ্ধার করে।  

আরও একটি ঘটনায়, ২১শে আগস্ট ২০২১-এ, রপ্তানি পণ্য আনলোড করার পরে বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা একটি খালি ভারতীয় ট্রাক থেকে ১,৬৮,৩৮,৫০০/- মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা (সৌদি রিয়াল উদ্ধার করা হয়েছিল।

বিশেষ সূত্রের খবর,বিএসএফ কর্মীরা ০৯ জানুয়ারী, ২০২২-এ এই আই সি পি-তে একটি ভারতীয় ট্রাক থেকে ৫০ কেজি গাঁজা বাজেয়াপ্ত করেছিল।  এছাড়াও, নিয়মিতভাবে, আইসিপি পেট্রাপোলে নিযুক্ত বিএসএফ মাদকদ্রব্য সহ বেশ কয়েকটি অবৈধ জিনিস আটক করা করে।  

ভারতীয় পরিবহণকারী, শ্রমিক, চালক, হেলপার এবং বিভিন্ন এজেন্ট/সহকারী এজেন্টরা এই সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপে ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ ৷
উল্লেখ্য, অনেক সময় ভুয়ো ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালকরা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন।  এমনকি ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে একজন ট্রাক চালকের হাতে পিষ্ট হয়ে বিএসএফ এর এক জওয়ানের প্রাণ হারিয়েছে। অতএব, এটিও প্রয়োজন যে বিএসএফ ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা পরীক্ষা করতে পারে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, এত দিন ধরে নির্দিষ্ট সংস্থার পরিচয়পত্র নিয়ে পার্কিংয়ের ভিতরে যাতায়াত করতেন শ্রমিকরা। কিন্তু এ বার তাঁদের সকলের জন্য এক পরিচয়পত্র করার কথা বলছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত সেই পরিচয়পত্র না হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত বর্তমান পরিচয়পত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করেছে আমদানিকারী সংস্থাগুলি। যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ বলে অভিযোগ। এই প্রতিবেদন লেখার মুহুর্ত পর্যন্ত শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়া নিয়ে বিতর্কের জেরে পেট্রাপোল সীমান্তে ব্ন্ধ আমদানি-রফতানি৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here