পার্থ সারথি নন্দী, বনগাঁ: ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রবাদটি দেশ ভাগের পর ও বনগাঁ সীমান্তের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। খেজুরের রসে গলা ভেজাননি এমন বাঙালি কমই আছেন। খেজুরের এই রস দিয়ে তৈরি গুড়-পাটালি ছাড়া শীতকালটা যেন জমে না। গুড়-পাটালি দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি-পায়েসের নাম শুনলেই জিবে জল আসে।

কার্তিক মাসের মাঝামাঝি এখন চড়ুইভাতির আমেজে মজেছেন বঙ্গবাসী। ভোজনরসিক বাঙালির পাতে এখন নানা রকমের পিঠেপুলির সঙ্গে অপরিহার্য খেজুড় গুড়ের পাটালি বা নলেন গুড়। আর এবার যেহেতু প্রায় সময় মত শীত এসেছে, তাই বাজারে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এতদিন আগের বছরের মজুত করা গুড়ই বিক্রি করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন শীতের শুরুতেই খেজুরের রসের যোগান পাওয়া যাচ্ছে। তাই এবার সেই রসের থেকেই তৈরী হচ্ছে তাজা পাটালি গুড়।

এই খেজুরের গুড় উৎপাদন এখন বাণিজ্যিক রূপ পাচ্ছে। আবার স্থানীয় বাজারের বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে ৷

খেজুরের গুড়ের পিঠাপুলি-পায়েস বাংলার শত বছরের ঐতিহ্য। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) যশোরের খেজুরের গুড়ের উল্লেখ আছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯০০-০১ সালে পূর্ব বঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের যশোরে প্রাকৃতিকভাবেই খেজুরগাছ হয়। দিগন্তজোড়া মাঠে খেজুরগাছের দীর্ঘ সারি। অপরিকল্পিতভাবে সড়কের পাশে, খেতের আলে, বাড়ির উঠোনে, উঁচু জমিতে রয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ।

তবে এ পার বাংলায় বনগাঁ-বাগদা সীমান্তের গ্রামগুলিতে এখন আর সেভাবে খেজুর গাছ চোখে পড়ে না ঠিকই৷ কারণ হিসেবে জানা গেছে বেশির ভাগ খেজুর গাছে রস ঠিকমত না হওয়ার কারণে বহু গাছ কেটে স্থানীয় ইট ভাটায় জ্বালানির কাজে ব্যবহার হয়েছে এমনই হাজার হাজার গাছ৷

যদিও অবশিষ্ট খেজুর গাছের রসে গলা ভেজান সীমান্তের বাসিন্দারা৷ বিশেষ করে বাগদার বাঁশঘাটা এলাকায় এখনও সড়কের পাশে, খেতের আলে, বাড়ির উঠোনে, উঁচু জমিতে রয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ। যা দিয়ে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ গুড়-পাটালি বানাচ্ছেন স্থানীয় গাছিরা ৷

গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ তোলা (গাছের উপরিভাগ চেঁছে পরিষ্কার করা) হয়। কয়েক দিন রেখে দিয়ে গাছের তোলা অংশ শুকানো হয়। অগ্রহায়ণের শেষে খেজুরগাছ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি চোখ কাটা হয়। নিচের দিকে বাঁশের নল বা নলি পোঁতা হয়। দুই চোখের মাঝ থেকে কেটে নল বা নলি পর্যন্ত একটি সরু পথ তৈরি করা হয়। নল বা নলির নিচে দড়ি দিয়ে মাটির তৈরি ভাঁড় ঝোলানো হয়। প্রতিবার চোখ দুটি কাটা হয়। চোখ থেকে পথ দিয়ে বেয়ে রস মাটির ভাঁড়ে এসে জমা হয়।

গাছিরা জানান, খেজুরের রস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতি মাটির ভাঁড় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, গুড় বিক্রি হয় ২০০ টাকা এবং পাটালি বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে।

শীতের তারতম্যের উপরেই খেজুর গাছ থেকে ভালো রস পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। মূলত এই বছর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই শীতের দেখা মিলেছে। আর তাই বাজারে এসে গিয়েছে খেজুর গুড়। যেহেতু শীত পড়লে খেজুর গাছ থেকে ভালো রস মেলে। তাই নভেম্বরের শুরুতে শীত পড়ছিল না বলে রীতিমত চিন্তায় ছিলেন গুড় প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীরা। তবে এখন সেই পরিস্থিতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। তাই দেরিতে হলেও জাঁকিয়ে শীত পড়বে এবছর বলে মনে করছেন তারা৷ আর গাছ থেকে মিলবে বেশি পরিমাণ রস।

মনমাতানো ঘ্রাণ আর রসনা তৃপ্ত করা স্বাদের নলেন গুড়ের জুড়ি নেই। মরশুমের শুরুতে খেজুরগাছ চেঁছে বাঁশের নল বা নলি পোতা হয়। নলি পোতার পর প্রথমবার সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়কে ‘নলেন গুড়’ বলে। এই রস কিছুটা নোনতা। অপূর্ব স্বাদ ও মনমাতানো গন্ধ এই নলেন গুড়ে। নলেন গুড় থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু সন্দেশ, প্যাড়া সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েস।

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে খেজুরের গাছ কাটছেন বাগদা এলাকার কৃষক অজয় প্রামাণীক। তিনি বলেন, ভেজাল গুড়-পাটালি চকচক করে। গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশালে পাটালি খুব শক্ত হয়। রসাল থাকে না। পাটালির রং কিছুটা সাদা হয়। গুড়ে হাইড্রোজ এবং ফিটকিরি ব্যবহার করলে পাটালির রং সাদা হয়। পাটালি ভীষণ শক্ত হয়। খেজুরের খাঁটি পাটালি চকচক করে না। রং কিছুটা লাল-কালচে হয়। পাটালি নরম এবং রসাল হয়। অনেক সময় পাটালির ওপরের অংশ কিছুটা শক্ত হতে পারে, কিন্তু ভেতরটা রসাল হয়।

এপার বাংলায় খেজুর গাছ সে ভাবে আর চোখে পড়েনা,গ্রাম গঞ্জে প্রায় গাছ কেটে জ্বালানির কাজে লাগানোয় ,দিনে দিনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছ।তার ফলে বাজারে যে সমস্ত পাটালি মিলছে তাতে বেশির ভাগই ভেজাল পাওয়ার অভিযোগ থেকেই যায়৷

বাগদা ব্লকের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যুৎ বিশ্বাসের কথায়, স্থানীয় হাটে ও বাজারে একটু নজর রাখলেই মিলে যাবে বাংলাদেশের যশোরের গ্রামে তৈরী খাটি নলেন গুড়৷ শীতের মরসুমে কাঁটা তার পেড়িয়ে অনায়াসে ওপার থেকে চলে আসছে মাটির কলসী ভর্তি নলেন গুড়৷ দামও হাতের নাগালে,তাই অনন্তত এই সমস্ত সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের ভোজনরসিক বাঙালির পাতে নলেন গুড়ের কোন অভাব নেই বলেই জানান তিনি৷

বিএস এফ এর এক আধিকারিককে গুড় পাচার হওয়ার কথা বলেতই এক গাল হেসে বললেন এতো মিঠা খবর,তবে কখনও ধরা পড়েনি ৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here