১৭৯০ সালে জানবাজারের রানী রাসমণির বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন রাসমণির শ্বশুর শ্রীযুক্ত বাবু প্রীতরাম মাড় ( দাস)। পরবর্তীকালে ১৮৩৬ সালে এই পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাসমণি। সেকালে রানী রাসমণির বাড়ির দুর্গাপুজোয় আগমন ঘটত অনেক মহান ব্যক্তিত্বের । যেমন-বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ।
রাসমণির বাড়ির প্রতিমা তৈরিতে কোন ছাঁচ ব্যবহার করা হয় না, সম্পূর্ণ হাত দিয়েই প্রতিমা তৈরি হয়। প্রতিমার রঙ তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, অনেকটা শিউলি ফুলের বোঁটার রঙ।
একচালার সাবেকি দুর্গা প্রতিমাকে শোলার সাজে সজ্জিত করা হয়। এখানে দেবীর বোধন হয় প্রতিপদে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী মায়ের ভোগে দেওয়া হয়- লুচি, পাঁচ রকম ভাজা ও রকমারি মিষ্টি। বাড়িতেই মিষ্টি তৈরি হয়। খাজা, গজা, প্যারাকি ও আরো অনেক কিছু। তবে পুজোর বিশেষ মিষ্টি হল ‘মাতৃভোগ’।
এই বনেদি বাড়ির বিশেষত্ব হল পুজোর এই বিশেষ তিন দিনই কুমারী পুজো হয়। তাছাড়া বাড়ির মহিলারা রাসমণির আমল থেকেই অন্দরমহলের একটি বিশেষ সিঁড়ি দিয়েই যাতায়াত করেন এই কদিন। মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঠাকুর দালানে আসা তাঁদের নিষেধ। আর দশমীর দিন মহিলারা মাকে বরন করেন না। কারন রানী রাসমণির সময় থেকেই এই প্রথা চলে আসছে।
অতিমারির সময় থেকে রানীর বাড়ির ঠাকুর দালানে বাইরের দর্শনার্থীদের আসার অনুমতি ছিল না, কিন্তু এ বছর সেই নিষেধাজ্ঞা আর থাকছে না। সন্ধিপুজোতেও সবাই থাকতে পারবেন বলে জানিয়েছেন রাসমণির উত্তরসূরী প্রসূন হাজরা।রানীর এই ঐতিহ্যবাহী পুজোর সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। প্রসূন হাজরার কাছ থেকেই জানা গেল সেই গল্প।
একবার রামকৃষ্ণদেব সখীবেশে রাসমণির বাড়ির পুজোয় উপস্থিত ছিলেন। আরেকবার পুজোর সময় এসে একেবারে জগদ্ধাত্রী পুজো অবধি কাটিয়ে যান। এরকম অজস্র ঘটনার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ এখানে করা হল, বিদ্যাসাগর মহাশয় রানী রাসমণিকে পিসিমা বলে সম্বোধন করতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পর বিধবা বিবাহে সত্যিই কারা ইচ্ছুক সেটা নিয়ে ওঁর মনে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
তাই রাসমণির বাড়ির দুর্গাপুজোয় সেই বছর বিদ্যাসাগর মহাশয় পিসিমার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করেন যে যাঁরা প্রথমেই বিধবাদের বিবাহ করতে ইচ্ছুক তাঁদের এই পুজোয় আমন্ত্রণ জানানো হোক। রাসমণি উৎসাহ সহকারে বিদ্যাসাগরের মতকে সমর্থন জানান।
অন্যদিকে এই সমাজসেবী রানী মনে মনে পাত্রদের একটা পরীক্ষা নেওয়ার ফন্দি করেন। নির্দিষ্ট দিনে নিমন্ত্রিত পাত্রদের, আগের সারির আমন্ত্রিতদের এঁটো পাতে খেতে বলা হয়। আসলে এটা পাত্রদের মনোভাব বিচারের একটা কৌশল ছিল মাত্র। এই ভাবে রাসমণির বাড়ির দুর্গাপুজো থেকেই প্রথম বিধবা বিবাহের প্রচার শুরু হয়।
তাই এই ঐতিহ্য মন্ডিত বাড়ির পুজো সবসময়ই দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।