গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত নয়াদিল্লী :
ছোট বেলায় আমরা সবাই বোধহয় সেই একগোছা লাঠির গল্পটা শুনেছি। সেই যে একটা লাঠিকে ভেঙে ফেলা যায় কিন্তু বেশ কিছু লাঠিকে একগোছা করে বাঁধলে তাদের আর সহজে ভাঙা যায়না। গল্পের মূল বক্তব্য হল, ঐক্যের শক্তি। যখন আইডিয়া বা প্রকল্প- এরাও ঐক্যবদ্ধ হয়, তখনই হয় ম্যাজিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই আইডিয়ার অন্যতম পতাকাবাহক। এই সরকারের কাছে একীকরণ বিষয়টি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় ২০১৪’য় তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় স্বর্গত অরুণ জেটলি বলেন, সরকারের কাজের অন্যতম প্রধান নীতি হল একীকরণ। জল শক্তি মন্ত্রকে আমরা সবসময় তা মেনে চলার চেষ্টা করেছি। এর সবথেকে ভালো উদাহরণ হল কিভাবে জল জীবন মিশন এবং স্বচ্ছ ভারত মিশন একসঙ্গে কাজ করছে এবং একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে তুলছে।
সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে উন্মুক্ত স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ প্রতিহত করাই ছিল অগ্রাধিকার। স্বচ্ছ ভারত মিশন চালু করা হয়েছিল। রেকর্ড সংখ্যক ১০ কোটি শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হতে পারত যদি না সরকার টুইন পিট ব্যবস্থায় শৌচাগার স্থাপন করতেন। এই ব্যবস্থায় কঠিন ও তরল বর্জ্য পৃথক করার বন্দোবস্ত থাকে। সরকারের দ্বিতীয় পাঁচ বছরে বাড়িতে নল বাহিত জল সংযোগ দানের জন্য জল জীবন মিশন চালু করা হল এবং আজ পর্যন্ত ৯.৬ কোটি গ্রামীণ পরিবার নল বাহিত জল পাচ্ছে এবং ২০১৯-এর আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর থেকে মোট ৬.৩ কোটি পরিবারে জল সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
জল জীবন মিশনের সামনে ঠিক স্বচ্ছ ভারত মিশনের কঠিন ও তরল বর্জ্য পৃথক করার মতোই একটি নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে। তা হল, দূষিত জল পৃথকীকরণ। যেহেতু গৃহস্থ বাড়িতে ব্যবহৃত ৭০% জলই দূষিত জলে পরিণত হয়, প্রক্রিয়াকরণ না করা হলে এর ফলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এইখানেই সরকার একীকরণের ধারণার প্রয়োগ করেছেন।
স্বচ্ছ ভারত মিশন ফেজ ২ শুরু করা হয়েছে। এতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ, কঠিন জৈব যৌগ দূষণ প্রতিরোধ, দূষিত জল এবং মল ঘটিত দূষণ প্রতিরোধে। লক্ষ্যণীয়, সরকার কিভাবে উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এখানে। স্বচ্ছ ভারত মিশন টুইন পিট শৌচাগার স্থাপন করেছিল যার জন্য নল বাহিত জলের প্রয়োজন ছিল না। আর যখন নল বাহিত জল সংযোগ দেওয়া হল তখন স্বচ্ছ ভারত মিশনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দূষিত জল প্রতিরোধে একটি সামগ্রিক নিকাশী ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা হল।
স্বচ্ছ ভারত মিশন ফেজ ২’র অধীনে এখনও পর্যন্ত ৪১৪৫০টি গ্রামে কঠিন ও তরল বর্জ্য পৃথকীকরণের বন্দোবস্ত হয়েছে এবং প্রায় ৪ লক্ষ গ্রামে জল জমার পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ বিরোধী প্রকল্প ওডিএফ+ এর অধীনে প্রায় ২২০০০ গ্রাম আছে। আরও ৫১০০০ গ্রাম খুব শীঘ্রই এই সম্মান পাবে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে জল জীবন মিশন এবং স্বচ্ছ ভারত মিশন অসাধারণ উন্নতি করেছে। এটাই প্রমাণ করে দুটি প্রকল্প একীভূত হলে কি সুফল পাওয়া যায়।
এছাড়াও সব সময় আমাদের প্রয়াস ছিল কি করে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে নিখুঁত করে তোলা যায়। প্রচলিত ব্যবস্থায় যে সমস্ত ফাঁক-ফোকর আছে সেগুলি বন্ধ করে সমাজের দরিদ্রতম মানুষের কাছে প্রকল্পের সুবিধা কিভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ স্বচ্ছ ভারত মিশন ফেজ ২তে স্বচ্ছ ভারত মিশনে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেগুলির সমাধান করা হয়। স্বচ্ছ ভারত মিশন শুরু হবারও আগে যেহেতু দুই তৃতীয়াংশ শৌচাগার মূল নিকাশী নালার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতোনা তাই ১,২০,০০০ টনের বেশি মল অপরিশোধিত থেকে যেত। প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রেও ভারতের পরিস্থিতি গুরুতর। স্বচ্ছ ভারত মিশন ফেজ ২’তে এই দুটি বিষয়েই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ৩.৫ লক্ষ গ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত হবে। একইভাবে ১৭৮টি মল পরিশোধন প্লান্ট এবং প্রায় ৯০,০০০ কিলোমিটার নর্দমা তৈরি করা হয়েছে।
প্রকল্পের একীকরণ হলে যে কি বিপুল সুবিধা হয় তার আলোচনায় মহিলাদের ওপরে এর প্রভাব সম্বন্ধে নজর দেওয়া হয়না। জল জীবন মিশন মহিলাদের জন্য বহু দূর থেকে পানীয় জল নিয়ে আসার কষ্ট লাঘব করেছে। স্বচ্ছ ভারত মিশন মহিলাদের সম্মান দিয়েছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ইউনিসেফের যৌথভাবে করা সমীক্ষায় দেখা গেছে ৮০% মহিলা বাড়িতে শৌচাগার তৈরির ফলে নিরাপদ বোধ করছেন এবং ৯৩% মহিলা মনে করেন তাদের সম্মান রক্ষিত হয়েছে।
গ্রামের জল পরিশোধন কমিটিগুলিতে ৫০% সদস্যপদ মহিলাদের দেবার মাধ্যমে জল জীবন মিশন তৃণমূলস্তরে পরিবর্তন আনছে। গ্রামের পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, পরিচালনার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে যোগদান করতে মহিলারা উৎসাহী হচ্ছেন। প্রত্যেক গ্রামে ৫-এর বেশি মহিলাকে পানীয় জলের মান পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং বহু মহিলাকে কলের মিস্ত্রি, পাম্প অপারেটর বা মেকানিকের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এদের দেখে আশা করা যায় বাচ্চা মেয়েরাও উৎসাহিত হবে এবং ভবিষ্যতে কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য থাকবেনা।
একটা বিষয়ে সবসময়ই আমরা নজর দিতে ভুলে যাই, জিডিপি-র ওপর এই প্রকল্পগুলির প্রভাব। ২০০৬-এ এডিবি (ADB), ইউকেএইড (UKAID) এবং ডাব্লুএসপি (WSP) এক যৌথ সমীক্ষা দেখিয়েছিল যে অপর্যাপ্ত নিকাশী ব্যবস্থার কারণে ভারতের ক্ষতি হয় ৫৩.৮ বিলিয়ন ডলার বা সেই সময়ে ভারতের জিডিপি-র ৬%। এতদসত্ত্বেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এ বিষয়ে খুব কমই কাজ হয়েছিল। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ফলে ভারতের জিডিপি-র ৬.৪% সাশ্রয় হচ্ছে। জল জীবন মিশন ভারতের মহিলাদের জন্য বছরে ১৫ কোটি কর্মদিবসের সাশ্রয় ঘটায়।
যে কোন সরকারের জন্যেই প্রতিটি বাড়িতে নলবাহিত জলের সংযোগ অথবা দেশকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ বিহীন করে তোলা খুবই গর্বের বিষয়। কিন্তু স্বচ্ছ ভারত মিশন বা জল জীবন মিশনের সাফল্য আমাদের সরকারকে আরও বড় এবং কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো শর্টকাট পছন্দ করেন না। সামাজিক সমস্যাগুলির মূলে কুঠারাঘাত করাতেই তিনি বিশ্বাসী এবং এই কারণেই তিনি সর্বদাই একীকরণের ওপর জোর দিয়েছেন। আমরা আন্তরিকভাবে এই শিক্ষাটি গ্রহণ করেছি এবং এই শিক্ষাই আমাদের কোনোকিছু অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রসর হবার পথে মানচিত্রের কাজ করে।