দেশের সময়: পাহাড়, জঙ্গল, চা বাগান, কমলালেবু, টয় ট্রেন তো আছেই। উত্তরবঙ্গের আরও একটি গর্ব বোরলি।তিস্তা-তোর্সার এই অলিখিত মাছের রাজাকে নিয়ে উত্তরের ভোজন রসিকদের স্বাদ আর আহ্লাদ দু’টোই বেশ উঁচু তারে বাঁধা। সেকালের রাজ পরিবারের অন্দর থেকে আমআদমির হেঁশেল কিংবা রাজনীতিবিদদের পছন্দের লাঞ্চের মেনু, সর্বত্রই অসীম কদর বোরলির। এবং তা খরস্রোতা নদীর মতোই বহমান যুগ যুগ ধরে। পর্যটক থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও রয়েছে সুস্বাদু বোরলির ব্যাপক পরিচিতি ও চাহিদা।


বিজ্ঞানসম্মত নামটা বেশ গালভরা-বারিলিয়াস বারিলা।রূপোলি শস্য। কিন্তু ইলিশ নয়। ডুয়ার্সের জঙ্গল আর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে আর এক ট্রেড মার্ক-তিস্তার বোরলি। দেখতে অনেকটা পার্সে মাছের মতো।চকচকে চেহারা। রসনায় অপূর্ব, তুলনাহীন। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, বাংলাদেশের মানুষও একডাকে চেনেন।পদ্মা আর ইলিশ যেমন সমার্থক, তেমনই তিস্তা আর বোরলি।


কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে এই মাছের প্রসঙ্গ। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মনের অভিব্যক্তি তুলে ধরে কবি রণজিৎ দেব লিখেছিলেন, ‘কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম রাস্তার পাশ দিয়ে ঝোরার জল গড়িয়ে যাচ্ছে ঢালুর দিকে। আদিবাসী দুই রমণী থালা পেতে বোরলি মাছ ধরছিল। আমাকে বুঝতে না দিয়ে শক্তিদা অনায়াসেই নেমে গেলেন। জলে নেমে চেঁচাতে শুরু করলেন, রণজিৎ কী দেখছো, দেখো কত বোরলি মাছ। আজ আর যাব না, ওরা বোরলি মাছের ঝোল খাওয়াবে আমাকে।’


কোচবিহারে রাজ আমলে, মহারানি ইন্দিরা দেবী বম্বে কিংবা কলকাতায় থাকলে বিমানে করে তোর্সার বোরলি মাছ যেত তাঁর কাছে। এতটাই পছন্দ ছিল মহারানির। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বোরলি প্রেম ছিল সর্বজনবিদিত। উত্তরবঙ্গে এলেই তাঁর লাঞ্চে ডাইনিং টেবিলে সাজানো থাকত বোরলি মাছের রকমারি পদ।বন দফতরের পাচক অধীর দাস জিরে-আদা বাটা দিয়ে এমন বোরলির ঝোল বানিয়ে দিতেন, তা চেটেপুটে খেতেন তিনি। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিংবা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেরই বোরলির প্রতি আকর্ষণ কোনও অংশেই কম নয়। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উত্তরবঙ্গ বলতেই তাঁর বোরলির কথা মনে পড়ে।


ভাঁপা বোরলি, বোরলি সর্ষে, দই বোরলি, বোরলি কালিয়া, বোরলি ঝাল, বোরলি পকোড়া কিংবা বোরলি টক, যেভাবেই রান্না করা হোক না কেন, যাঁরা চেখে দেখেছেন, তাঁদের কথায়, অমৃত সমান।বোরলির প্রেমের টান এতটাই যে, তিস্তা পাড়ে একাধিক রেস্তরাঁ তৈরি হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র এই মাছের নানা পদ দিয়ে পর্যটকদের রসনা তৃপ্তির জন্য। পাহাড়-ডুয়ার্স ভ্রমণ সেরে অনেকেই মালবাজার কিংবা গজলডোবায় সেসব রেস্তরাঁয় একবার ঢুঁ মেরে যেতে ভোলেন না। ভাজা, চচ্চরি, ঝাল কিংবা কালো জিরে ফোড়নে বোরলির পাতলা ঝোল দিয়ে উত্তরবঙ্গের সুগন্ধী চাল তুলাইপাঞ্জির ভাত মানেই জিভে জল।খাঁটি বোরলি ঈষৎ মিষ্টি, মুখে দিলেই গলে যাবে।

পর্যটকরা এই মাছের স্বাদ আস্বাদনে উন্মুখ হয়ে থাকেন। ফলে বাজারে সবসময়ই বোরলির দাম থাকে বেশ চড়া।
গজলডোবার এক রেস্তরাঁর সেফ বলছিলেন, আমরা পর্যটকদের যেমন বোরলি ভাজা করে দিই। তেমনই আবার সরু করে বেগুন কেটে, আলু দিয়ে পাতলা ঝোল করে, তার উপর ধনেপাতা ছড়িয়েও পরিবেশন করে থাকি। সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশ স্টাইলে বোরলি ভাপাও চেখে দেখতে পারেন।একেবারে ফিদা হয়ে যাবেন।পেঁয়াজ বাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা, ধনেপাতা বাটা দিয়ে না ভেজে সাঁতলে একবার বোরলি খেয়ে দেখবেন, স্বাদটা জিভে লেগে থাকবে অনেকদিন।


শুধু উত্তরবঙ্গের নদীতেই বোরলি পাওয়া যায়। তাও আবার সব নদীতে নয়। জলঢাকা, কালজানি, তিস্তা, তোর্সাতেই মেলে। জলঢাকা ও তোর্সার বোরলি তুলনামূলক খর্বকায়। তবে স্বাদে গন্ধে তিস্তার বোরলিই সবার সেরা।তিস্তার স্রোত বেয়ে আসা এই মাছের স্বাদ অন্য কোথাও আর মেলে না। সেজন্য অনেকে একে আদর করে তিস্তার ইলিশ নামে ডাকেন। আগে অসমের ধুবুরিতে ব্রহ্মপুত্রেও আঙুল সাইজের এই মাছটি পাওয়া যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব নদীতেই বোরলির সম্ভার কমেছে।আগের মতো আর দেখা পাওয়া যায় না তাদের।


তবু মাছ বিলাসীরা বোরলির টানেই বারবার ফিরে যান উত্তরবঙ্গে। ইলিশের মতোই নদীর স্রোতের বিপরীতে ঝাঁক বেঁধে চলে বোরলি। মূলত বর্ষার আগেই এপ্রিল-মে মাসে কিংবা বর্ষার পরে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এদের দেখা মেলে। রাত জেগে জেলেরা তিস্তার এই রূপোলি শস্যকে জালবন্দি করেন।সকালের নরম রোদে রূপোলি মাছের ঝিলিকে হাসি ফোটে তিস্তাপাড়ের জেলেদের ৷

কালীপুজোর পর থেকেই শীতের আমেজ গায়ে মেখে বোরলি শিকারে নেমে পড়েন মৎস্যজীবীরা। তাঁদের পাকড়াও করতে সঙ্গী বিশেষ জাল। মূলত ছোট জাল দিয়েই বোরলি ধরা হয়ে থাকে, একে বোরলি জাল বলা হয়। কোথায়, কোন বাঁকে ঘাপটি মেরে রয়েছে তারা, সেই গোপন খবর জানেন জেলেরা। ভোররাতে সেই ঘাঁটিতে হানা দিয়েই তুলে আনেন চার থেকে ছয় ইঞ্চি সাইজের এই মাছেদের। তবে আঁতুরঘরের সন্ধান না জানলে গোটা তিস্তা ছানবিন করে ফেললেও সেভাবে বোরলির দেখা পাওয়া মুশকিল। গজলডোবায় যেমন বোরলির ঘরসংসার রয়েছে, তেমনই জলপাইগুড়ি শহরের কাছে চার নম্বর স্পার এলাকায় জাল ফেললে নিরাশ হতে হয় না জেলেদের। বোরলি ধরার পর তিস্তার পাড়েই বাজার বসে যায়। হামলে পড়েন পর্যটকরা।নিমেষে শেষ হয়ে যায়। কিছুটা চলে যায় আড়তে।

অতি সুস্বাদু বোরলি কী খায়।জলে ভাসমান আণুবীক্ষনিক প্রাণী ডাফনিয়া আর সাইক্লপ বোরলির সবচেয়ে বেশি পছন্দ। শৈবালের মধ্যে পছন্দ ভলভক্স আর স্পাইরোগাইরা।কিন্তু নদীতে এই শৈবালের খোঁজ পাওয়া দিনদিন মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


বাজারে লোক ঠকাতে বোরলির যমজ মাছও রয়েছে। বিহারের কোশি নদীতে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যার নাম পিয়ালি। খুব ভালো করে না চিনলে প্রথম দেখায় ভুল হতেই পারে। তবে রান্নার পর মুখে দিলে সেই ভুল ভাঙতে মোটেই সময় নেবে না।
জয়া, কক্সা, ছেবলি, আনুজের মতো কি একদিন হারিয়ে যাবে বোরলি?


কীটনাশক প্রয়োগ, জল দূষণ, ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুতের শক দিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাছ ধরার প্রবণতা, বর্ষায় নেট ব্যবহার করে ডিমভর্তি মাছ ধরা, সবমিলিয়ে বোরলির সংখ্যা কমছে দিনদিন। চাপলা, নেদস, কাজলি, মৌরালার মতো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বোরলি। বাজারে যেদিন তার দেখা মেলে, প্যাকেটবন্দি করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা লাগে আমজনতার।


মহার্ঘ বোরলির স্বাদ আস্বাদন থেকে যাতে কেউ বঞ্চিত না হন, সেজন্য জোগান বাড়াতে কয়েক বছর আগে উদ্যোগ নেয় মৎস্য দপ্তর। পুকুরে এই মাছটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কি না, তা নিয়ে শুরু হয় পরীক্ষানিরীক্ষা। সেই গবেষণা সফল হয়েছে। উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে পুকুরেও যে বোরলিকে সংরক্ষণ করা যেতে পারে, সে বিষয়ে আশার আলো দেখা গিয়েছে বলে দাবি মৎস্য বিজ্ঞানীদের।বোরলির সংসার বাড়াতে চেষ্টা চলছে নানাভাবে।কখনও জিভে জল আনা বোরলির মেনু সামনে হাজির করে উৎসব। কখনও আবার সচেতনতা শিবির।


আর পাঁচটা চুনো মাছের মতোই বোরলি প্রাণিজ প্রোটিনের একটি বড় উৎস।এছাড়াও এতে রয়েছে ক্যালিশিয়াম ও ভিটামিন ডি।শুধু তাই নয়, এই মাছটি মিনারেল ও নানা ধরনের পুষ্টিগুণেরও অন্যতম আধার। এতে রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্কের মতো শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিও। গবেষকরা জানিয়েছেন, তিস্তা-তোর্সার মতো বড় না হলেও দেখা গিয়েছে, পুকুরেও বোরলিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। তবে উত্তরের ঠান্ডার পরিবেশ দক্ষিণে দিতে পুকুরকে একটু গভীর করতে হবে। যাতে গরম মনে হলে বোরলি নিজেই একটু গভীর জলে চলে যেতে পারে।

এছাড়াও পাহাড়ি নদীতে মাছেরা অক্সিজেন বেশি পায়। তাই বদ্ধ জলাশয়ে যাতে বোরলির অক্সিজেনর ঘাটতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনে যন্ত্র বসিয়ে নিশ্চিত করতে হবে জলে অক্সিজেনের মাত্রা। মৎস্য বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য, রুই-কাতলার মতো বোরলিরও কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো। এই দ্বিতীয় ধাপে সফলতা এলে আগামী দিনে বোরলির সংখ্যা বাড়ানো যাবে বলে আশা তাঁদের। সেদিন হয়তো কলকাতার গড়িয়ার বাজারে দেখা মিলবে উত্তরবঙ্গের এই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের।আপাতত সেদিনের অপেক্ষা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here