দেশের সময়: বই পার্বণের  আজ দশমী। ফলে মন খারাপ বাংলার বইপ্রেমীদের। তবুও শেষলগ্নে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে কলকাতামুখী পাঠকরা। রবিবার ছুটির দিন। ফলে সব কাজ ফেলে সকাল সকাল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার মাঠে পা রাখার পরিকল্পনা সেরে রেখেছেন অনেকেই। এতটুকু যাতে সময় নষ্ট না হয়, সেজন্য সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে এবং বিজ্ঞাপন দেখে, কোন প্রকাশনের কোন বই ভালো, তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন তাঁরা। এখন অপেক্ষা স্টলে গিয়ে প্রিয় লেখকের পছন্দের বইটি হাতে তুলে নেওয়া।

প্রতি বছরই এই বইমেলা থেকে জন্ম নেন বহু নতুন লেখক। পাঠকদের ভালবাসায় তাঁরা পরিচিত হন। পাঠকের হাত ধরেই তাঁদের লেখা ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে। এবারের মেলাতেও বহু লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। নিজেদের বইকে পাঠকের দরবারে তুলে ধরতে চেষ্টার কসুর রাখেননি তাঁরা। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত তাঁদের বইয়ের প্রচার করে গিয়েছেন। পাঠকের আশায় নিজের তাগিদে প্রকাশকের স্টলে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন দিনের পর দিন।

কোনও পাঠক যখন এসে অনেক বইয়ের ভিড়ে তাঁর বই হাতে তুলে নিয়েছেন, কিনেছেন, আনন্দে লাফিয়ে উঠেছেন সেই নতুন লেখক। পাঠকের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতে এতটুকু সময় নেননি। সদ্য বিক্রি হওয়া বইটি পাঠকের হাত থেকে নিয়ে যেচে সইও করে দিয়েছেন তাতে। এসব নিয়ে কেউ কেউ আড়ালে আবডালে টিপ্পনি কাটতেও অবশ্য ছাড়েননি। অনেকে আবার এমন মন্তব্য করেছেন, আশেপাশে যাকে দেখছি, তারই একটা, দু’টো বই প্রকাশ হয়েছে। মেলার মাঠে তো পা রাখা যাচ্ছে না। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেই তাঁর বই কেনার জন্য আবদার জুড়ে দিচ্ছেন।

কেউ কেউ তো আবার টানতে টানতে স্টলে নিয়ে গিয়ে বই হাতে তুলে দিচ্ছেন। না করার উপায় থাকছে না। ফলে বইমেলায় খুব সাবধানে পা রাখতে হচ্ছে। পাছে কোনও পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়ে না যায়। প্রকাশকদের প্রচ্ছন্ন চাপও রয়েছে। নতুন লেখকের বই ছাপার শর্তে প্রকাশক আগেভাগেই বলে রেখেছেন, এত কপি বই নিজের দায়িত্বে বিক্রি করে দিতে হবে। না হলে গাঁটের থেকে পয়সা দিতে হবে লেখককে। কথা রাখতে না পারলে পরেরবার ওই প্রকাশক আর বই ছাপবেন না। ফলে প্রকাশককে খুশি করতে রীতিমতো বই বিক্রিতে নেমে পড়েছেন নবীন লেখক। দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে বইমেলাকে মাতিয়ে রেখেছেন তাঁরাই। তাঁদের কাছে আইকন নতুন প্রজন্মের নাম করা লেখক, লেখিকারা। বইয়ের প্রতি এই অমোঘ টানকে অবশ্য ভালোভাবেই দেখছেন প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিকরা। তাঁদের কথায়, নতুন প্রজন্ম যত বেশি করে বইকে ভালবাসবে, ততই বইমেলার জৌলুস বাড়বে। এবারের বই বিক্রিতে খুশি প্রকাশকরা।

প্রথম কয়েকটা দিন বাদ দিয়ে মোটের উপর সবদিনই বিকেল থেকে করুণাময়ীর বইমেলা প্রাঙ্গনে পা রাখার জায়গা ছিল না। যেদিকে তাকানো গিয়েছে, শুধুই কালো মাথার ভিড়। বড় প্রকাশনের স্টলগুলির সামনে দীর্ঘ লাইন। প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার মতো করে লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনেছেন পাঠক। এদিকে, শনিবার বইমেলার নবমীতেও বইপাড়া কলেজস্ট্রিটের ব্যস্ততা থেমে থাকেনি। প্রশাসকরা সকাল থেকে এসে হত্যে দিয়ে পড়েছিলেন। কারও আবদার, পিওডিতে দশ কপি বই ছাপিয়ে দিন। না হলে মানসম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। লেখককে কথা দিয়েছি, মেলার শেষ দিনে হলেও স্টলে বই রাখব। প্রকাশকদের কেউ আবার রিপ্রিন্টের জন্য জোড়াজুড়ি করেই চলেছেন। বাইন্ডিং যাই হোক না কেন, কয়েকটা কপি ছেপে দিন প্লিজ। স্টলটা একদম ফাঁকা। পাঠক ফিরে যাচ্ছেন।

সারা বছরের ব্যবসা। ফলে প্রকাশকদের মুখের উপর না বলে দিতে পারছেন না, কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করা তো মুখের কথা নয়। তবুও চোয়াল চাপা জেদ নিয়ে ছাপাখানায় পড়ে রয়েছেন প্রকাশক। শেষদিনে হলেও বই নিয়েই বইমেলায় পা রাখবেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বই হাতে পেয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে বাসে, ট্যাক্সিতে সোজা সল্টলেক করুণাময়ী। এভাবেই কলকাতা বইমেলা হয়ে উঠেছে বই পার্বণ । সেই পার্বণের রবিবার ছিল শেষলগ্ন। পাণ্ডুলিপি জমা দিতে দেরি, প্রুফ দেখার লোক না পাওয়া, প্রচ্ছদ শিল্পী ঝুলিয়েছেন, সব মিলিয়ে প্রেসে যেতে দেরি করেছে বই, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে প্রেসে ছোটাছুটি করেও যে সব প্রকাশক লেখকের হাতে বই তুলে দিতে পারলেন না এই বইমেলায়, এখন তাঁরা আশ্বাস দিচ্ছেন বাংলা নববর্ষে বই প্রকাশ হবে। অনেক লেখক আবার বইমেলার শেষ দু’টো দিন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার স্টলে ঘুরে ঘুরে প্রকাশকের সঙ্গে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতে যদি কাজে লাগে। কিন্তু বইমেলায় কথা বলার ফুরসত নেই প্রকাশকদের। ফলে ফোন নম্বর দিয়ে তাঁরা বলে দিচ্ছেন, মেলার পর কলেজ স্ট্রিটে এসে কথা বলুন। সেলিব্রিটি লেখকদের নিয়েই তাঁরা এখন ব্যস্ত। সেইসব লেখকদের জন্য বসার চেয়ার, চা-কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কের আয়োজন করতে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টার সামলানো চাপের হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেক প্রকাশকের। তবুও কী আর করা যাবে। যত্নআত্তি তো করতে হবে। পরের বইটাও তো চাই। গোঁসা হলে যদি অন্য কোনও প্রকাশনাকে দিয়ে দেন বই।

এবারের বইমেলায় পা রেখেছেন প্রবীণ বাম নেতা বিমান বসু। সঙ্গে ছিলেন তরুণ তুর্কি নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। চা-আড্ডার মাঝেই বইমেলার সঙ্গে জুড়ে থাকা স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন বিমানবাবু। বলেন, বইমেলা মানুষের বড় আদরের জিনিস। পুরনো দিনের বইমেলার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বিমান বসু বলেন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের দেওয়ালের গায়ে ১৯৭৫ সালে প্রথম কলকাতা বইমেলা শুরু হয়। পরপর দু’বছর সেখানে বইমেলা হয়। ১৯৭৭ সালে সেখানেই বইমেলা হলেও আকারে একটু বড় হয়। এরপর ১৯৭৮ সাল থেকে বইমেলা চলে আসে ময়দানে। 

বলেন, পৃথিবীর সবদেশেই বইমেলা হয়। তবে ফ্রাঙ্কফুটের বইমেলা সবচেয়ে বড় বলে জানি। কলকাতা থেকেও সেই বইমেলায় অনেকে যান। কলকাতা বইমেলা বড় প্রিয় একটা অনুষ্ঠান। এখানে সব বয়সের মানুষ আসেন। বইয়ের সন্ধানে। তাঁরা বই কেনেন। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বইমেলায় আসেন, বেশি করে ধুলো ছড়াতে। তাঁরা বই কেনেন না। ফুডকোর্টে খাওয়াদাওয়া করেন। গল্পগুজব করেন। এটা সব যুগেই এমন কিছু মানুষ থাকেন। তাঁদের জন্য বইমেলার কোনও অঙ্গহানি হয় না। 

শেষের মুখে বইমেলা। আস্ত ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ কেটে গেল বইমেলায়। হাত ধরাধরি করে ঘোরা। আড্ডা। গিটার বাজিয়ে গান। সেলফি। তারই মাঝে বইয়ের প্রতি টান। মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকা নতুন প্রজন্মের বইয়ের প্রতিও টান দেখে খুশি প্রকাশকরা। কেউ ট্যাক্সি, কেউবা বাস থেকে নেমেই হনহনিয়ে ঢুকে মিশে যাচ্ছেন বইমেলার ভিড়ে। শেষ বিকেলের কনে দেখা আলোয় বইয়ে মুখ গুঁজে পাঠক, এই ছবিই তো দেখতে চান প্রকাশক। আর এখানেই তো কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার সার্থকতা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here