দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ যে অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল তাঁকে, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল এ যুদ্ধ জেতা কঠিন হবে বহু যুদ্ধের তুখোড় নায়কের পক্ষেও। শেষমেশ আজ, বুধবার সন্ধে ছ’টা পাঁচ মিনিট নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ঘোষণা করা হল, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ভারতীয় সেনার তিন বাহিনীর প্রধান বিপিন রাওয়াতের।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দিল্লির তরফে বলা হয়েছিল, বায়ুসেনার কপ্টারে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, বিপিন রাওয়াতের স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াতও। কিন্তু ওয়েলিংটন বেস হাসপাতাল তখনও সরকারি ভাবে রাওয়াতের ব্যাপারে বিবৃতি দেয়নি। হাসপাতাল শুধু জানিয়েছিল, বিপিন রাওয়াতের দেহের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। এর পরে সরকারি ভাবে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হল সন্ধেয়।

দেশের তিন বাহিনীকে সংযুক্ত করার পর বিপিন রাওয়াতই ছিলেন প্রথম প্রধান। ২০১৯ সালে দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ওই বছর থেকেই প্রথম ওই পদের সূচনা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে।

১৯৫৮ সালের ১৬ মার্চ অধুনা উত্তরাখণ্ডের পাউরিতে হিন্দু গাড়োয়াল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাওয়াত। দেরাদুনের কেমব্রেন স্কুল ও সিমলার এডওয়ার্ড স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি।

স্কুল শিক্ষার পর ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন রাওয়াত। এরপর ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি কমান্ড অ্যান্ড জেনারেল স্টাফ কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি।

তাঁর পরিবারে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইতিহাস পুরুষানুক্রমিক। বাবা লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়ত ছিলেন ভারতীয় সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল।

সেই রীতি মেনেই সেনায় যোগদান রাওয়তের। শিমলার সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান পুণেয়। খড়কভাসলার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে। এর পর দেহরাদূনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে যোগ দেন সেনার ১১ গোর্খা রাইফেলস ব্যাটালিয়নে।

দীর্ঘ কর্মজীবনের বড় অংশ জম্মু ও কাশ্মীরে কাটিয়েছেন রাওয়ত। সোপোরে সন্ত্রাসদমন অভিযান থেকে রজৌরির নিয়ন্ত্রণরেখায় পাক হামলা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। পেয়েছেন উত্তম যুদ্ধ সেবা মেডেল, পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল-সহ একাধিক সেনা-সম্মাননা। আফ্রিকার কঙ্গোয় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনার একটি ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। মেজর জেনারেল হিসেবে ১৮ নম্বর পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বও পালন করেছেন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাওয়ত নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে সেনার ৩ নম্বর কোরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। এর পর হন পুণেয় দক্ষিণাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের প্রধান। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

প্রসঙ্গত, সেনাপ্রধান পদে রাওয়তের পূর্বসূরি জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগ ২০১৪-র অগস্টে দায়িত্ব নিলেও তাঁর নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল মনমোহন সিংহ সরকারের জমানায়।

রাওয়ত সেনাপ্রধান থাকাকালীন কাশ্মীরে পাথর ছোড়া ঠেকাতে এক বিক্ষোভকারীকে জিপে বেঁধে ঘুরিয়েছিল সেনা। সেই পদক্ষেপ সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। এর পর কাশ্মীরে বিক্ষোকারীদের পাথরে সেনাদের আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘পাথরের বদলে ওরা যদি গুলি ছুড়ত, আমাদের পক্ষে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হত।’’

তিন বছর কাজ করার পর ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্থলসেনা প্রধানের অবসর নেওয়ার কথা ছিল রাওয়তের। তাঁর এক দিন আগে দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে নিযুক্ত করে মোদী সরকার।

বিপিনের আগে ভারতের দুই প্রাক্তন সেনাপ্রধান কে এম কারিয়াপ্পা এবং শ্যাম মানেকশকে অবসরের পর আলঙ্কারিক ভাবে ফিল্ড মার্শাল পদে উত্তীর্ণ করা হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনার সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব পাননি। মোদী সরকার সেনা বিধি সংশোধন করে রাওয়তকেই প্রথম তিন বাহিনীর ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজর’-এর দায়িত্ব দিয়েছিল। জল্পনা ছিল, অবসরের আগে রাওয়তকেও পাঁচতারা ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হতে পারে। জীবদ্দশায় সেই সুযোগ পেলেন না রাওয়ত।

আজ বুধবার বেলা ১২টা ৪০ নাগাদ তামিলনাড়ুতে নীলগিরি পাহাড়ের উপরে বিপিন রাওয়াতকে নিয়ে ভেঙে পড়ে সেনার হেলিকপ্টার! চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ অর্থাৎ প্রতিরক্ষা প্রমুখ বিপিন রাওয়াত ছাড়াও এমআই সিরিজের ১৭ভি-৫ কপ্টারে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াত এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আরও সাত জন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ছিলেন ৫ জন ক্রু সদস্যও। মারা গেলেন সকলেই।

বিপিন রাওয়াতের মৃত্যুর পরে দুঃখপ্রকাশ করে টুইট করেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি লিখেছেন, “চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াতের অকালমৃত্যুতে গভীর ভাবে মর্মাহত। তাঁর স্ত্রী এবং আরও ১১ জন সেনাকর্মীও শিকার হয়েছেন তামিলনাড়ুর ভয়াবহ কপ্টার-ক্র্যাশের। দেশের জন্য এবং সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here