দেশের সময় , বনগাঁ : মৃত্যুও কোনওভাবেই স্মৃতি মুছিয়ে দিতে পারেনি। তাই বরুণ বিশ্বাসের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল বনগাঁর সাধারণ ছাত্র যুবকেরা৷ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নীল দর্পণ পেক্ষাগৃহের সামনে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান ও বরুণে অবদান নিয়ে অনেকেই নিজের বক্তব্য রাখেন। এদিনের স্মরণসভায় হাজির হয়েছিলেন বহু মানুষ৷
বনগাঁয় বরুণের স্মরণসভার আহ্বায়ক তুহীন রায় বলেন, গান ,কবিতা এবং বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের বক্তবের মাধ্যমে স্মৃতি হাতড়ে উঠে এল বরুণ বিশ্বাসের অবদানের কথা৷ এদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গান ও কবিতায় স্বরণ করা হয় বরুণকে৷ তাঁর প্রতীকীতে ফুলের মালা দিয়ে মোমবাতি জ্বেলে তাঁর খুনের বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবিতে এদিন থেকে আনন্দ শুরু হল গণসাক্ষরের মাধ্যমে ৷
অন্যদিকে বরুণের মৃত্যুদিনে সুটিয়ায় গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সামনে তাঁর মূর্তিতে নমো নমো করে মালা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাজির মেরেকেটে ১৫ জন। এলাকার অনেককে জিজ্ঞেস করে বোঝা গেল, দিনটার কথা আর তাঁদের মনেই নেই। তবে মনে করিয়ে দেওয়ার পরে অনেকের কপালেই চিন্তার ভাজ দেখা গেছে তবে কেউই মুখ খোলেননি৷
এবার একটু পিছনে ফেরা যাক। ২০০০-২০০২, এই সময়টা রীতিমতো দুষ্কৃতীদের স্বর্গ রাজ্য হয়ে উঠেছিল উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার সুটিয়া। খুন, ধর্ষণ লেগেই থাকত। দু-আড়াই বছরের মধ্যে আনুমানিক ৩২টি ধর্ষণ ও ১২টি খুনের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার হন মূলত দরিদ্র পরিবারের শ্রমজীবী মহিলারা।
আশ্চর্যের হল, প্রশাসন তো বটেই প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ অংশ এই সব ঘটনা নিয়ে নীরব ছিল। স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বরুণ গড়ে তোলেন সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ। মঞ্চের আন্দোলনে অস্বস্তি বাড়ে তৎকালীন শাসক দল সিপিএম এবং স্থানীয় প্রশাসনের। দুষ্কৃতীদের হুমকির মুখেও চলে আন্দোলন ৷
প্রশাসনকে আরও চাপে ফেলে বরুণদের উদ্যোগে এলাকার জলাশয় বাঁচানোর আন্দোলন। এলাকার নিকাশি খালের গতিমুখ বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল স্থানীয় একটি প্রভাবশালী অংশ। বরুণরা সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু করেন। তাতেও বরুণ ও তাঁর সহযোগীদের উপর আক্রোশ বেড়ে গিয়েছিল প্রভাবশালীদের।
২০১২ সালের ৫ জুলাই উত্তর ২৪ পরগনার সুটিয়ার যুবক বরুণকে গোবরডাঙা স্টেশন চত্বরে গুলি করে মারে দুষ্কৃতীরা।
গাইঘাটায় একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনায় এলাকায় প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ওই সব ঘটনায় কয়েক জন দুষ্কৃতী ধরা পড়ে। সাজাও হয়। কয়েকটি মামলায় মূল সাক্ষী ছিলেন বরুণ। সে কারণেই দুষ্কৃতীরা তাঁকে সরিয়ে দিল, এই অভিযোগে উত্তাল হয় সুটিয়া। মিত্র ইন্সটিটিউশনের (মেন) বাংলার শিক্ষক বছর চল্লিশের বরুণ রাজ্যে হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের মুখ।
প্রতিবাদী তরুণের দেহ সেদিন এলাকায় পৌঁছেছিল বিকালে স্থানীয় স্কুলের মাঠে তখন কাতারে কাতারে লোক। হাতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। চোখের জলে ভাসছেন কত জন!
তাঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার মানুষ শপথ নিয়েছিলেন খুনের বিচার আদায় করার পাশাপাশি দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তাঁরা। গঠিত হয় বরুণ বিশ্বাস স্মৃতিরক্ষা কমিটি। বরুণের বাড়ির কাছেই বসে তাঁর মূর্তি। কিন্তু আন্দোলন? খুনের বিচার?
বরুণের পরিবার জানান, কোনও অগ্রগতি নেই। থেমে গিয়েছে আন্দোলন। তাঁরা সিবিআই তদন্ত দাবি করেছিলেন। সে দাবিও মেটেনি। ক্ষোভের সঙ্গে তাঁরা আরও বলেন, এখন বুঝতে পারছি, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তখন বরুণের সঙ্গে অনেকে হাত মিলিয়েছিল। এখন তাঁদের আর দেখা নেই।
প্রতিবাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বরুণ এলাকার দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোয় সাহায্য করতেন। পড়াশুনোর সামগ্রী, প্রাইভেট টিউটরের বেতন ইত্যাদির খরচ দিতেন বহু দুঃস্থ পড়ুয়াকে।
সেই কাজগুলো এখনও চালিয়ে যাচ্ছে পরিবারের তরফে, তবে আর কতদিন এভাবে চলবে তাঁদের জানানেই৷ কারণ হিসেবে বরুণের পরিবার জানান তাঁদের পাশে কেউ নেই। বরং, বিচার চাইছে বলে নানাভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে তাঁদের পরিবারকে।
তাঁদের কথায়, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দু-চারজন ছাড়া একমাত্র বরুণ যে স্কুলে শিক্ষকতা করত সেই মিত্র ইনস্টিটিইউশন এবং সেখানকার ছাত্র, শিক্ষক ও বর্তমান পরিচালকমণ্ডলী মনে রেথেছে বরুণকে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে কোনও আন্দোলন নয়, বরং একক প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লব। নারীর মর্যাদা রক্ষার্থেই হোক বা নদী বাঁচানোর আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই হোক, বরুণ বিশ্বাস এক এবং অনন্য। আর সেই আন্দোলনের জন্যেই প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল তাঁকে।
আসল প্রশ্নের জবাব মেলেনি আজও, কার নির্দেশে বরুণকে খুনের সুপারি দিয়েছিল? বরুণ যে অনেকের আক্রোশের কারণ হয়েছিলেন তা অজানা ছিল না পরিবার এবং প্রিয়জনদের। কিন্তু তার পরিনামে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল কার? বরুণ কী এমন ক্ষতি করেছিলেন, কার ক্ষতি করেছিলেন ,কে সেই ব্যক্তি? উত্তর মেলেনি আজও!
সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের নেতাদের কথায় বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। তবে এ নিয়ে নতুন করে আন্দোলনের জায়গা বিশেষ নেই। এলাকার মানুষ তেমন ভাবে সামিল হতে চাইছেন না।’’ গত কয়েক বছরে প্রতিবাদী মঞ্চের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছে বরুণের পরিবারের।
তবে বরুণের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে বনগাঁর একদল ছাএ-যুবক তাঁর স্মরণসভা থেকে ফের তাঁদের প্রিয় শিক্ষকের খুনের বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবিতে নতুন করে আনন্দ শুরু করলেন গণসাক্ষরের মাধ্যমে ৷