দেশের সময়: শুধু নৃশংস নয়, ভয়াবহ। বাংলাদেশের আওয়ামি লিগের সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনারকে খুন করে তার দেহ ৮০ টুকরো করা হয়। বানানো হয় কিমা। একাজে ভাড়া করা হয় কসাইকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন খুন হলেন বাংলাদেশের ওই এমপি। কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে একাধিক সম্ভাবনা।
এই খুনের ঘটনায় মূল চক্রী হিসেবে যার নাম উঠে আসছে, তিনি আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি আখতারুজ্জামান। ওই সাংসদেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আনোয়ারুল আজিমকে খুনের জন্য কলকাতার নিউ টাউনে ফ্ল্যাট ভাড়া করেন আখতারুজ্জামান। তারই পরিকল্পনা মাফিক সবটা হয়েছে। চক্রীদের মধ্যে অন্যতম আমানুল্লাহ, যার আসল নাম শিমুল ভুঁইয়া। তিনি একসময়ের চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) নেতা। এরা আগে সমাজবিপ্লবের জন্য শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি করতেন। এখন ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আনোয়ারুল। বরাবর থেকেছেন ক্ষমতার বলয়ে। রাজনীতিতে তাঁর উত্থান চোখে পড়ার মতো। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতা এবং পরে আওয়ামি লিগের সাংসদ আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে বিএনপির টিকিটে কালীগঞ্জ পুরসভার কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৯৫ সালে মান্নান বিএনপি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামি লিগে। সেসময় আনোয়ারুল অনুসরণ করেন তাঁকে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। তখন ভারতে চলে আসেন আনোয়ারুল। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও সোনা চোরাচালান, তোলাবাজি, টেন্ডাররাজ, দখলদারি এবং চরমপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মামলা ছিল অন্তত ন’টি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল তাঁর বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্টও জারি করে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এলে আনোয়ারুল দেশে ফেরেন। তবে ২০০৮ সালের ভোটে মনোনয়ন পাননি তিনি। সেবার টিকিট পান তাঁরই গুরু মান্নান। পরেরবার অর্থাৎ ২০১৪ সালে মান্নানকে পাশ কাটিয়ে টিকিট হাসিল করেন আনোয়ারুল। তখন থেকেই শুরু হয় গুরু-শিষ্যের দ্বন্দ্ব। কিন্তু আবদুল মান্নান মারা যাওয়ার পর ঝিনাইদহে আওয়ামি লিগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে একই আসন থেকে জয়ী হন আনোয়ারুল। এই সময়কালে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি চোখে পড়ার মতো। বিপুল সম্পত্তির মালিক তিনি। তবে ঝিনাইদহের মানুষ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কেউ বিপদে পড়লে তাঁকে সাহায্য করতেন আনোয়ারুল। অনেক সময় গাড়ি ছেড়ে ঘুরতেন বাইকে চড়ে। তবে রাজনীতিতে সুবিধাবাদী বলে দুর্নাম ছিল তাঁর। পাশাপাশি সীমান্তকেন্দ্রিক ব্যবসাতেও প্রচুর এদিক-ওদিক ছিল সাংসদের, এমনটাও অভিযোগ।
রাজনীতিতে আসার আগে ভিসিআর, ভিসিডির ব্যবসা ছিল আনোয়ারুলের। জাপান থেকে তিনি ভিসিআর আমদানি করে বিক্রি করতেন ভারতে। এখান থেকেই তাঁর ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
এদিকে, আখতারুজ্জামানের সঙ্গে আনোয়ারুলের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে ঝিনাইদহের মানুষ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, খোলা চোখে যতটুকু দেখা যেত, দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক ভালই ছিল। তাঁরা একসঙ্গে ফুটবলও খেলেছেন একসময়। পরে আনোয়ারুল রাজনীতিতে সক্রিয় হন। আর আখতারুজ্জামান চলে যান আমেরিকায়।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আমেরিকা প্রবাসী হলেও আখতারুজ্জামানের মূল ব্যবসা ছিল সোনা চোরাচালান। আবু ধাবি থেকে সোনা নিয়ে এসে তিনি বিক্রি করতেন ভারতে। একাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন আনোয়ারুল আজিম, এমনটাই অভিযোগ। সম্প্রতি কয়েকটি চালান গায়েব করে দেন এমপি।
যার দাম প্রায় দু’শো কোটি টাকা। ওই টাকার জন্যই পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে সাংসদকে। যদিও এনিয়ে পুলিশকর্তারা এখনই মুখ খুলতে নারাজ। এদিকে, সোনা পাচারের কারবারে বাংলাদেশের ওই এমপির নাম জড়াতেই এপাড়ে কোথায় কোথায় তিনি জাল বিছিয়েছিলেন, সে ব্যপারেও তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। ভারতে চিকিৎসার নাম করে এসে এমপি আনোয়ারুল বরানগরে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে উঠেছিলেন বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। কিন্তু সেখানে দু’দিন থেকে তিনি নিউ টাউনে আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে চলে আসেন। খুনের পিছনে তা হলে কি সোনা চোরাচালানই মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে? পুলিশ ও গোয়েন্দারা এখনই অবশ্য এনিয়ে কিছু বলতে চাইছেন না।