18 August: বনগাঁয় স্বাধীনতার পতাকা ওঠে ১৮ অগস্ট! জানুন ইতিহাস

0
1442

অর্পিতা বনিক , বনগাঁ: সারা ভারতবর্ষের জন্য ১৫ অগস্ট হতে পারে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের দিন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এমন কিছু গ্রাম ও শহর আছে, যে সব অঞ্চলে ১৫ অগস্ট একটা অপেক্ষার দিন। অপেক্ষা কীসের? স্বাধীনতা দিবসের অপেক্ষা। তাও আবার তিন দিন পর! দেখুন ভিডিও

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, এই বাংলাতেই উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, ও মালদা জেলায় বেশ কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগস্ট নয়। অর্থাৎ, তারা ১৫ অগস্ট ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

জানা গেছে, ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। সেদিন যখন ভারতের সর্বত্র জাতীয় পতাকাতোলা হলো তখন দেখা গেল বনগাঁ বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশভাগের এই সীমারেখার ম্যাপ তৈরি করার দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল র‍্যাডক্লিফ সাহেব। তার তৈরি সেই ম্যাপ দেখে হতাশ হয়ে পড়েন বনগাঁর মানুষ। এটা ভুলবশত হয়েছে এটা বুঝতে পেরে তখনকার বনগাঁর ম্যাজিস্ট্রেট সি কুইন সাহেবের মাধ্যমে খবর পৌঁছায় দিল্লিতে।

১৯৪৭ সালের ১২ অগস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করেছিলেন যে, ১৫ অগস্ট ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। সিরিল র‍্যাডক্লিফ-এর আঁকা দেশভাগের ম্যাপ অনুযায়ী, নদিয়া ও মালদা জেলার বেশ কয়েকটি অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সব জায়গায় হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠল। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নদিয়ার রাজ পরিবারের কিছু সদস্যের মাধ্যমে এই প্রতিবাদের খবর কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে পৌঁছল।‌ মাউন্টব্যাটেন বিষয়টি জানতে পেরে তড়িঘড়ি ম্যাপ বদলানোর হুকুম দিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে এই কাজ মিটতে মিটতে আরও দিন চারেক পার।

শেষ পর্যন্ত, ১৭ অগস্ট মধ্যরাতে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় যে বনগাঁ যশোর নয় স্বাধীন ভারতের ২৪ পরগনার অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এর পরদিন অর্থাৎ ১৮ আগস্ট সকালে বনগাঁ মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলা হয় । সেই দিনটিকে স্মরণ করে আজও বনগাঁ আদালত চত্বরে ১৮ আগস্ট আলাদা করে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলেন বনগাঁ আদালতের আইনজীবীরা।

বনগাঁ আদালতের আইনজীবী দীপাঞ্জয় দত্ত বলেন, এদিনটার কথা প্রথমে স্কুলে পড়ার সময় মাষ্টার মহাশয়ের কাছে জেনেছিলাম তারপর কলেজ পেরিয়ে আজ আইনজীবীর পেশায় এসে নবীন প্রবীনদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সময় যে আনন্দ পাই তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা ৷ এদিন সকাল ১১: টায় পতাকা উত্তোলনের পর মিষ্টি বিতরণ করার ব্যবস্থাও হয়৷

ইতিহাসের এই চাপা পড়ে যাওয়া অধ্যায়টির স্মৃতি এখনও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেশ কিছু গ্রামে রয়েছে। শুধু ব্রিটিশ শাসন থেকে নয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকেও আলাদা হওয়ার দিন হিসেবে বেশ কিছু গ্রাম ১৮ অগস্ট দিনটিকে পালন করে, যে দিন তারা ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

এলাকার মৌখিক পরম্পরায় এই কাহিনি সর্বজনবিদিত হলেও স্বাধীনতা দিবসের তিন দিন পরে আলাদা করে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন করাটা ঠিক হবে কি না, তা ভেবে একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই এই দিনটিকে বিশেষ ভাবে উদ্‌যাপন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু পরে সবাই একমত হন যে, এলাকার ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকা উচিত।

১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট বনগাঁয় যে পতাকাটি উড়েছিল, সেটি পূর্ব পাকিস্তানের, ভারতের নয়। তাই ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার দিন হিসেবে ১৮ অগস্ট দিনটাকেই তারা উদ্‌যাপন করে।

শিবনিবাস গ্রাম ছাড়াও নদিয়া জেলার আরও বেশ কয়েকটি শহর, যেমন কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, কল্যাণী, শিকারপুর, করিমপুর— এই সব ক’টিই আদতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। এই সব অঞ্চলেও ১৫ অগস্টের পরে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের প্রথা রয়েছে। যেমন রানাঘাটে ’৪৭-এর ১৫ অগস্ট উড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা। আরও দু’দিন পর, ১৭ অগস্ট মাঝরাতে রানাঘাট আনুষ্ঠানিক ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের আওতা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন ভারতের অংশ হয়।‌ তাই এখানেও ১৫ অগস্টের বদলে ১৮ তারিখ সকালে জাতীয় পতাকা তোলার রেওয়াজ রয়েছে। মালদা জেলার রতুয়া ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের ইতিহাসও এ রকমই। এই অঞ্চলগুলোও দেশভাগের পর প্রাথমিক ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। জনগণের প্রতিবাদে পরে এগুলো ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এগুলোর কোনওটিতে ১৭, আবার কোনওটিতে ১৮ তারিখ স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। এ রকম আলাদা আলাদা দিনের কারণ হল, যে অঞ্চল যে দিনে সরকারি ভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সে অঞ্চলে সেই দিনটি বাসিন্দারা বিশেষ ভাবে পালন করেন।

তার মানে এটা নয় যে, এ সব জায়গায় ১৫ অগস্ট জাতীয় পতাকা তোলা হয় না। কিন্তু শুধুমাত্র ১৫ অগস্টে স্বাধীনতা উদ্‌যাপন সীমাবদ্ধ না রেখে, ভারতের অংশ হয়ে ওঠার দিনটিকেও পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়। ইতিহাস সচেতনতার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন। বাঁধা গতে না হেঁটে, আঞ্চলিক ইতিহাসকে স্মরণে রেখে, ১৮ অগস্ট দিনটিও স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গ্রাম-শহরে।

Previous articlePresident Of India: মমতা-দ্রৌপদীর হাত ধরে জলে নামল ‘‌আইএনএস বিন্ধ্যগিরি’‌ কলকাতার প্রশংসায় রাষ্ট্রপতি 
Next articleWeather Update: আজ কেমন থাকবে বাংলার আবহাওয়া? জানুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here