দেশের সময়: দেখতে যেমন সুন্দর। খেতেও তেমনই সুস্বাদু। আর এই দুইয়ের কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ড্রাগন ফ্রুট। সঙ্গে স্বাস্থ্যগুণ তো রয়েইছে। নিয়মিত এই ফলটি খেলে অনেক জটিল রোগ থেকে দূরে থাকা যাবে, এমনটাই বলছেন পুষ্টিবিদ থেকে চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ড্রাগন ফ্রুটে ক্যালোরির পরিমাণ কম থাকায় ডায়েটের জন্য এটি খুবই ভালো। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীরা অনায়াসেই খেতে পারেন। ড্রাগন ফ্রুটে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ভিটামিন সি। ফলে এই ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে শরীরে। ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়। ডায়েটারি ফাইবার থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ফলটি লিভারের জন্য উপকারি। পেটের রোগ সারে। ড্রাগন ফ্রুটে ভালো মাত্রায় আয়রন রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে লোভনীয় এই ফল।
পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় অনেকে ড্রাগন ফ্রুটকে সুপারফুড বলে থাকেন। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের কাছে এই ফল দৈনিক খাদ্যাভাসে পরিণত হয়েছে। পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, ড্রাগন ফ্রুটে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে প্রচুর মাত্রায়। তথ্য বলছে, ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফ্রুটে ক্যালোরির পরিমাণ ৬০, প্রোটিন রয়েছে ১.২ গ্রাম, ফ্যাট শূন্য, কার্বোহাইড্রেট ১৩ গ্রাম, ফাইবার ৩ গ্রাম, ভিটামিন সি দৈনিক চাহিদার ৩ শতাংশ, আয়রন দৈনিক চাহিদার ৪ শতাংশ এবং ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে দৈনিক চাহিদার ১০ শতাংশ। এছাড়াও পলিফেনলস, ক্যারোটিনয়েডস, বিটা কায়ানিন্স-এর মতো উপকারি উপাদানও পাওয়া যায় এই ফলে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় ড্রাগন ফ্রুট নিয়মিত খেলে শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালস যা কোষের ক্ষতি করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। গবেষণা বলছে, দৈনন্দিন ডায়েটে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার থাকলে বাত, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো রোগ থেকে শরীর দূরে থাকে। একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ভিটামিন সি রয়েছে এমন খাবার বেশি মাত্রায় খেলে ঘাড় ও মাথার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে। টেস্ট টিউব সমীক্ষায় ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে, বেটালাইনস স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। ক্যান্সারের কোষকে দমিয়ে রাখে।
ক্যারোটিনয়েডস, বিটা ক্যারোটিন ও লাইকোপিন হল উদ্ভিদ রঞ্জক, যা ড্রাগন ফ্রুটকে দারুণ রং দেয়। ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার ক্যান্সার ও হৃদরোগের আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ডায়েটারি ফাইবার নন ডাইজেস্টেবল কার্বোহাইড্রেট। এর যথেষ্ট পরিমাণে স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন একজন পুরুষকে ৩৮ গ্রাম ও একজন মহিলাকে ২৫ গ্রাম ডায়েটারি খাবার খাওয়া উচিত। ফাইবার হজমের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা গিয়েছে, টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্যতম কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে ফাইবার।
কিছু গবেষণা বলছে, উচ্চমাত্রায় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে কোলন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে শরীরে। চিকিৎসকদের অনেকের বক্তব্য, পেটের অস্বস্তি দূর করতে এবং হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি খাবার খাওয়া উচিত। ড্রাগন ফ্রুটে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যকে উন্নত করতে পারে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, ড্রাগন ফ্রুট হল আয়রন সমৃদ্ধ ফল। আয়রন শরীরে অক্সিজেন পরিবহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় প্রকাশ, বিশ্বে ৩০ শতাংশ মানুষের শরীরে আয়রনের ঘাটতি রয়েছে। ড্রাগন ফ্রুট আয়রনের ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। এই ফলটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি থাকায় শরীরে আয়রন শোষণে সহায়তা করে থাকে। ফলটি ম্যাগনেশিয়ামেরও অন্যতম উৎস।
আমাদের শরীরে মোটামুটি ২৪ গ্রাম ম্যাগনেশিয়াম থাকে। আপাতদৃষ্টিতে তা অল্প মনে হতে পারে। কিন্তু এই খনিজ পদার্থটি শরীরের প্রতিটি কোষে ৬০০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর, পেশি সংকোচন, হাড়ের গঠন ও ডিএনএ তৈরির মতো কাজে ম্যাগনেশিয়ামের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় প্রকাশ, ভালোমাত্রায় ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
ড্রাগন ফ্রুট প্রি-বায়োটিক ফাইবার সমৃদ্ধ। আর প্রি-বায়োটিক পেটের প্রদাহ ও কোলন ক্যান্সারের উপসর্গ কমিয়ে দিতে পারে, এমনটাই দাবি করা হচ্ছে। প্রি-বায়োটিক হল নির্দিষ্ট ধরনের ফাইবার, যা অন্ত্রে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কিছু ফাইবার অন্ত্র সরাসরি হজম করতে পারে না। কিন্তু পেটে থাকা ব্যাকটেরিয়া হজম করে ফেলে। তারা বৃদ্ধির জন্য জ্বালানি হিসেবে ফাইবারটিকে ব্যবহার করে। নিয়মিত প্রি-বায়োটিক গ্রহণ করলে পাচনতন্ত্র ভালো থাকে। ডায়ারিয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।
একসময় ড্রাগন ফ্রুট মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকায় দেখা যেত। এখন মোটামুটি গোটা বিশ্বেই চোখে পড়ে। এতদিন মূলত চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামে রমরমা ছিল ড্রাগন ফ্রুটের। এখন তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় ফলটি। বাংলাতেও দিন দিন ড্রাগন ফ্রুটের চাষ বাড়ছে। শখ থাকলে বাড়ির ছাদে কিংবা ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে টবেও ক্যাকটাস জাতীয় এই অনবদ্য ফলের গাছটি লাগানো যায়। কোনও কোনও দেশে এই ফলকে বলা হয় ফায়ার ড্রাগন। কোথাও বলা হয় সুইট ড্রাগন।
উদ্যানপালন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ১০০ গ্রাম ওজনের ড্রাগন ফ্রুটের মধ্যে ৫৫ গ্রাম খাওয়ার যোগ্য থাকে। বাজারে এই ফলটির দাম চারশো থেকে ছ’শো টাকা কেজির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। বালি মাটিতে ড্রাগন ফ্রুট ভালো হয়। ১৮ মাসের মধ্যে ফল দেয়। সাদা, লাল ও হলুদ—এই প্রজাতির ফল হয়। ফল পাড়ার ১০-১২ দিন পরও তাজা থাকে। মে মাসে ফল আসে। নভেম্বর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। ড্রাগন ফ্রুট আড়াআড়ি কাটলে চামচ দিয়ে ভিতরের শাঁস আইসক্রিমের মতো তুলে নেওয়া যায়। শাঁসের ভিতরে কালো বীজ থাকে। যা থেকে চারা তৈরি করা যায়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই ফলগাছটি ভালো হবে। খুব অম্ল বা ক্ষারীয় মাটি ছাড়া সব মাটিতেই ড্রাগন ফ্রুট ভালোভাবে চাষ করা সম্ভব। তবে মাটিতে যেন জল না দাঁড়ায়।
উদ্যানপালন বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ড্রাগন ফ্রুটের আর এক নাম পিয়াতা। এই ফল রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। কোলেস্টেরল দূর করে। অ্যান্টি ফাংগাল ও অ্যান্টি বায়োটিক হিসেবেও কাজ করে। প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে। টক্সিন প্রতিরোধক হিসেবে এই ফলের বিরাট অবদান রয়েছে। চোখের জটিল রোগ দূর করতে পারে ড্রাগন ফ্রুট। এই ফলটিতে পাইটোঅ্যালবুমিন নামে এক ধরনের যৌগ রয়েছে। যা মানবদেহে নানা রোগ প্রতিরোধ করে।