দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ রাত তখন ১১:২০ হবে। সারা দিনের কাজের পর ধীরে ধীরে বিছানার দিকে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ। বাকি বাংলার অনেকেই হয়তো শুয়ে শুয়ে মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। হঠাৎই বজ্রাঘাতের মতো খবর এসে পৌঁছলো কে কে আর নেই!
মঙ্গলবার সন্ধেতে রবীন্দ্র সরোবর লেকের নজরুল মঞ্চে কে কে-র লাইভ পারফরম্যান্স ছিল। মূলত গুরুদাস কলেজের অনুষ্ঠান হলেও বাইরের কিছু জনও পাস নিয়ে ঢুকেছিলেন। তাঁরা কেউ কেউ মিনিট ৩০ আগে বাড়ি ফিরেছেন। হঠাৎ এই খবর তাঁদের কাউকে গভীর বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দিল, আবার কেউ কেউ কে কে-র শেষ অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গভীর স্মৃতিচারণায় ডুব দিলেন।
কলকাতার অনুষ্ঠানে এসে চিরঘুমে চলে গেছেন বলিউড কাঁপানো সঙ্গীতশিল্পী কে কে। তাঁর এই আচমকা অকাল মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না অনুরাগীরা। এই দেশজোড়া শোকের মাঝে নিজের জীবনের একটা করুণ অধ্যায় ভাগ করে নিলেন বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় । দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে জানালেন তাঁর সঙ্গে কে কে-র রসায়ন।
শ্রীজাত লিখলেন, ‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’… গানের কথাকে একজীবনে এমন অসহ সত্যি করে দিয়ে চলে যাবার মতো মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে। কে কে তাঁদেরই একজন। ১৬ বছরের গভীর ক্ষতের উপর মলমের বদলে মশাল চেপে ধরলেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল গায়ক রূপঙ্কর বাগচীর মন্তব্য। সোমবার কলকাতায় কে কে-র (K K) পারফরম্যান্সের পর ‘এ তুমি কেমন তুমি’-র জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত রুপঙ্কর ফেসবুক লাইভ করে কেকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বলেছিলেন Who is KK?
আর যায় কোথায়, কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ তো একটা নাম নয়, বড় হয়ে ওঠা একটা গোটা প্রজন্মের আবেগ। তাই রুপঙ্করকে নিয়ে এমনিতেই তুলোধোনা চলছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ এই বাঙালি গায়কের যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করেছিলেন, আবার কেউ শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে কে কে-র হঠাৎ মৃত্যু সব হিসেবটাই গুলিয়ে দিল। এরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও দেখা গেল মানুষ আবেগ থেকে কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও যুক্তিহীন কথা বলতে পারে!
কেউ কেউ বলে বসলেন, “রুপঙ্করের জন্যই অকালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে বিদায় নিলেন কে কে”! কেউ বললেন, “ও সমালোচনা করলেই মৃত্যু নিশ্চিত। এবার রূপঙ্কর কোন গায়কের সমালোচনা করে দেখা যাক”! কেউ কেউ আবার সংশয় প্রকাশ করলেন, রুপঙ্করের সমালোচনা কেকের উপর ব্যাপক মানসিক চাপ তৈরি করেছিল, সেই কারণেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন এই ভারত বিখ্যাত গায়ক! কয়েকজন তো আবার কে কে-র মৃত্যুর পিছনে রুপঙ্করের হাত আছে কিনা তা নিয়ে তদন্তের দাবিও জানিয়ে বসলেন!
এই নিয়ে প্রশ্ন করায় উত্তর ধেয়ে এল, “এটা আবেগ, ও আপনারা বুঝবেন না”!
তবে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়াও দেখা গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই আবেগের নামে এই কুসংস্কারচ্ছন্নতাকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। বেশিরভাগই গায়ক রূপঙ্কর বাগচীর মন্তব্যকে সমর্থন না করেও কে কে-র মৃত্যুতে তাঁর হাত নেই বলে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ আবার কে কে-র মৃত্যুর জন্য রুপঙ্করকে দায়ী না করলেও তাঁর নৈতিকতা ও মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বাংলা পক্ষের গর্গ চট্টোপাধ্যায়ও রুপঙ্করের পাশে দাঁড়িয়ে লিখেছেন, “অকপট সত্য লাইভের আঘাতে কেউ মারা যায়নি, যাবেওনা”।
তবে অনেকেই কে কে-র মৃত্যুর সঙ্গে বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তুলনা টেনে এনেছেন। সব মিলিয়ে মঙ্গলবার রাতে সোশ্যাল মিডিয়া কে কে-ময় হয়ে উঠল, “পল…. ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পর”…. এই অবস্থার বর্ণনা কে কে-র গান দিয়েই একমাত্র সম্ভব। যার রেশ বুধবার সকালেও আছে।
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বুধবার সকালে কলকাতায় এসে পৌঁছলেন কেকে-র স্ত্রী জ্যোতি। মঙ্গলবার রাতেই গায়কের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন তাঁর ২১ বছরের জীবনসঙ্গী। তখনই জ্যোতি জানিয়ে দেন, সকালের প্রথম বিমানেই আসবেন কলকাতায়। বুুধবার সকাল ৯টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছয় তাঁর বিমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুত্র নকুলও।
বুধবার সকালে এসএসকেএমে ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে গায়কের। তবে তাঁর শেষকৃত্য কোথায় হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন জ্যোতিই। সূত্রের খবর ময়নাতদন্তের পরই কেকে-র দেহ নিয়ে মুম্বইয়ে ফিরবেন তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র।
কে কে-র এই মৃত্যু কি স্বাভাবিক? তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
কে কে-র মৃত্যুর পর কলকাতার নিউমার্কেট থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করা হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতাতেই এই মৃত্যু কিনা, এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে কিনা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
শোনা যাচ্ছে, নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান চলাকালীন কে কে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ব্যাকস্টেজে গিয়ে দুই থেকে আড়াই মিনিট বসেছিলেন তিনি। মঞ্চেই নাকি ঘামছিলেন দরদর করে। আলোতে তাঁর সমস্যা হচ্ছিল। স্পটলাইন বন্ধ করে দিয়ে বলেছিলেন। এসবই খতিয়ে দেখা হবে তদন্তে।