দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ কালো পোশাক পরা নিরাপত্তারক্ষীরা যখন নজরুল মঞ্চে ভিড় সরিয়ে গায়ক কেকে-র যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দিচ্ছেন, তখনই দৃশ্যতই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে।

অথচ মিনিট দশেক আগেও তিনি মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। মাতিয়ে দিয়েছেন গুরুদাস কলেজের ‘ফেস্ট’। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান শেষ করেন তাঁর নব্বইয়ের দশকের সাড়া ফেলা বন্ধুত্বের গান দিয়ে। মঙ্গলবার রাতে মঞ্চ থেকে নামার আগেও গেয়েছেন, ‘ইয়ারো দোস্তি বড়ি হি হাসিন হ্যায়, ইয়ে না হো তো কেয়া ফির বোলো ইয়ে জিন্দগি হ্যায়…’ । কিন্তু সেই শেষ গান গাইতে উঠে সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়েন শিল্পী। কারণ স্টেজ থেকে নেমে যখন হেঁটে তিনি নজরুল মঞ্চের বাইরে বেরোচ্ছেন তখন তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে, চোখ বুজে এসেছে ক্লান্তিতে। কুলকুল করে ঘামছেন গায়ক।

মঞ্চে গায়কের শেষ ভিডিয়ো ছিল ওটিই। তবে প্রকাশ্যে এসেছে আরও কয়েকটি ভিডিয়ো। সেগুলি আরও আগের। তার একটিতে দেখা গিয়েছে অনুষ্ঠান চলাকালীনই বার বার অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন গায়ক। পাশে সঙ্গীদের বুঝিয়েছেন তাঁর গরম লাগছে। এমনকি, গান গাইতে গাইতে কিছু ক্ষণের জন্য থেমে মঞ্চের পাশে এসে ঘাম মুছতেও দেখা গিয়েছে শিল্পীকে। তবু থামেননি। শেষ গান গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমেছেন। পারফর্মার এবং শিল্পী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব থেকে অসুস্থ হয়েও চ্যুত হননি কেকে।

ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোকজনকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল নজরুল মঞ্চে, প্রবল ভিড়ে গরমও বেড়েছিল পাল্লা দিয়ে। তার মধ্যেই মঞ্চে পারফর্ম করছিলেন কেকে। ৫৩ বছর বয়সি গায়কের সুরে-তালে উদ্বেল হয়ে উঠছিল তরুণ-তরুণীদের সমুদ্র। এমনটাই তো হয়, এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরেও এমন কিছু হল, যা আশা করেননি কেউ। প্রাণ চলে গেল গায়কের ৷

তথ্য বলছে, নজরুল মঞ্চে দর্শক ধরে মেরেকেটে আড়াই হাজার। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেখানে অন্তত সাত হাজার লোক ঢুকেছিলেন বলে জানা গেছে। অনেকে নাকি পাঁচিল টপকেও ঢুকেছিলেন। ভিড় সামলাতে নজরুল মঞ্চের সাতটি দরজার মধ্যে পাঁচটিই খুলে দেওয়া হয়েছিল বলে ওই সূত্রের দাবি। এর ফলে গরম আরও বাড়ে।

সংগৃহীত ভিডিও

এখানেই শেষ নয়। ভিডিওয় দেখা গেছে, মঞ্চের সামনে ভিড় হটাতে একটা সময় সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থেকে রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, সেই স্প্রে-র কারণেই কেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন! যদিও তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত।

এসবের পাশাপাশিই আজ, বুধবার সকালে চিকিৎসক কুণাল সরকার তাঁর ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করেছেন। যেখানে প্রয়াত কেকে-র একটি সাদা-কালো ছবি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যতটা দুঃখ, ততটাই লজ্জা। বেসামাল ভিড়। এসি বেহাল-ভীষণ গরম। মুখের উপর ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার স্প্রে করা। দু’ঘন্টার উপর সময় নষ্ট করে তার পর শেষ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। আমাদের ক্ষমা করো।’

জানা গেছে, নজরুল মঞ্চে গান শেষ করার পরেই ধর্মতলার হোটেলে ফিরে আসেন প্রয়াত গায়ক। ফেরার পথে গাড়িতে শীত লাগায় তিনি এসি বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন। এমনকি কেকে-র হাত-পায়ের পেশিতেও খিঁচুনি হচ্ছিল বলে জানা গেছে। হোটেলে ফেরার পরেও তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে অনেকে ভিড় করেছিলেন, তিনি বারণ করে দেন। এর পরেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, পড়েও যান, চোট পান। তার পরেই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

বাংলায় রবীন্দ্র সদনেই প্রয়াত শিল্পীদের শ্রদ্ধা জানানো হয়, প্রয়াত গায়ক কেকের মরদেহও এসএসকেএম থেকে রবীন্দ্র সদনেই আনা হবে বলে ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার দুপুরে বাঁকুড়া থেকে কলকাতায় ফিরেই দমদম বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মমতা জানান, তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে গায়কের পরিবারের কথা হয়েছে। তাঁদের মুম্বই ফেরার বিমানের সময় দেখেই শিল্পীর দেহ রবীন্দ্র সদনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মমতা জানিয়েছেন সদনেই গান স্যালুট দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে মুম্বইয়ের নেপথ্যগায়ককে।

বিমানবন্দরে এই ঘোষণা করার পরই সেখান থেকে সোজা রবীন্দ্র সদনে পৌঁছে যান মমতা। সেখানে শিল্পীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায় তাঁকে। প্রসঙ্গেত, এর আগে কলকাতা বিমানবন্দরে কেকে-কে গান স্যালুট দেওয়ার হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তবে তখন তিনি বাঁকুড়ায় ছিলেন। পরে কলকাতায় ফিরে সেই সিদ্ধান্ত বদলের কথা জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলায় প্রয়াত শিল্পীদের আমরা রবীন্দ্র সদনেই শ্রদ্ধা জানাই। ওঁকেও আমরা রবীন্দ্র সদনেই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তবে একই সঙ্গে মমতা জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তে কেকে-র পরিবার কোনও সমস্যায় পড়বে না। মমতা বলেছেন, ‘‘ময়নাতদন্ত করতে সময় লাগবে। ওঁদের বিমান বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে। তার আগেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রক্রিয়া শেষ হবে।’’

বুধবার সকালেই গায়ক কেকে-র ময়নাতদন্ত শুরু হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। দুপুরে মমতা জানান, সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে। যেহেতু বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাই ‘ভাল ভাবে ময়নাতদন্ত করতে সময় লাগবে’ বলেও জানান মমতা। তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, এসএসকেএম থেকে শিল্পীকে রবীন্দ্র সদনে আনার পর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেও শিল্পীর দেহ নিয়ে সময়েই মুম্বইয়ে ফিরতে পারবেন তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র।

ময়নাতদন্তের পরও মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ বোঝা না গেলেও, এ কথা অস্বীকার করার কারণ নেই, যে বেসামাল, বেলাগাম ভিড় এবং তার জেরে বিশৃঙ্খলার অভাব ছিল না গতকাল। কিন্তু তার জেরে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেকে! তার আগে তিনি থামলেন না, বা আয়োজক-উদ্যোক্তারা কেউ থামালেন না তাঁকে! তথ্য বলছে, কেকে-র হার্টের তেমন সমস্যা ছিল না। তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করতেন। ফিট ছিলেন শারীরিক ভাবে। সে জন্যই কি নিজের শেষবিন্দু পর্যন্ত নিংড়ে দিতে চেয়েছিলেন মাঠভর্তি দর্শকদের জন্য?

উত্তর জানা যাবে না হয়তো শেষমেশ। ভুলগুলো সংশোধন করার সুযোগও আসবে না। এবিষয়ে এখনও মুখ খোলেননি কলেজ কর্তৃপক্ষ বা অনুষ্ঠান আয়োজক সংস্থা। কিন্তু এখন সকলেই বলছেন, ঘটনাপরম্পরা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here