পার্থ সারথি নন্দী:- সাম্প্রতিক সময় একটা ঘটনা আমাদের অনেকের নজরে এসেছে।ঘটনাটা হচ্ছে ক্যামাক স্ট্রিটের এক প্যান্টুলুনস্ বিপণন কেন্দ্রে কর্মীরা ক্রেতাদের বাংলা ভাষায় আমন্ত্রন করায় সেখানকার কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজন কর্মীকে ছাঁটাইয়ের নোটিশ ধরিয়ে দেয়।ঘটনাটা হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যেত যদি না সেখানকার অন্যান্য কর্মীরাও কর্তৃপক্ষের অন্যায় জুলুমবাজির প্রতিবাদে একত্রে গর্জে না উঠতেন।

বাংলা বলে ক্রেতাদের আমন্ত্রন করায় কয়েকজনকে কাজ থেকে বসিয়ে দেবার প্রতিবাদে সেই বিপণীর সকল কর্মী ধর্নায় বসে যায়।শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী প্যান্টুলুনস্ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে তাদের সিদ্ধান্ত বদল করে,আবার সবাই কাজে যোগ দিতে পেরেছে।ঘটনাটা মোটেও সাধারণ ঘটনা নয় এর অভিঘাত ব্যাপক।ভেবে অবাক হতে হয় পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে কেউ বাংলা বলার অপরাধে চাকরি হারাবার সম্ভাবনার সামনে পড়ছে।

আসলে কিন্তু এই অবস্থাটা একটু একটু করে এ রাজ্যে তৈরি হয়ে গেছে।হিন্দি আগ্রাসনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে তা আমরা বুঝেও না বোঝার মত করে চুপ থেকেছি।আর এই কারণেই বিপদটা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।বাংলার ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা ভাষা বলতে হিনমন্যতায় ভুগছে,বাংলা এখন আক্ষরিক অর্থেই ‘চাকর-বাকরের’ ভাষা বলে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।যে কেউ যে কোন দিন ধর্মতলা থেকে নিউমার্কেট,সেখান থেকে পার্কস্ট্রিট,ক্যামাক স্ট্রিট চলে যান দেখবেন হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাই সেখানে সবার মুখে মুখে ঘুরছে।

এমনকী বাঙালি ছেলেমেয়েরাও হিন্দি বলছে বাংলা ছেড়ে।যে কোন আধধুনিক সপিংমল ঘুরলেি বোঝা যাবে বাংলা ক্রমশ পিছু হটছে।হিন্দি বা ইংরেজি না জানলে যথেষ্ট স্মার্ট হওয়া যায় না সবাই এই সত্য মেনে নিতে শিখছে।আর মুষ্টিমেয় কেউ বাংলা বললেও সেই ভাযায় কী ভাবে ঢুকে পড়ছে অসংখ্য হিন্দি ও ইংরেজি শব্দ।একটা বাংলার পড়েই জুড়ে বসছে ইয়ার,ছোড়,দেখা যায় গা ভাই.ডরনা কেয়া কুছ করকে দিখানা হ্যায় ইয়ার এই নানা হিন্দি শব্দের কোলাজ।এক জগাখিচুড়ি ভাষা যা বাংলা ভাষার সৌন্দর্ষ তার সাবলীলতাকে ভেঙে চুড়ে তছনছ করে দিচ্ছে।কেন এ রাজ্যে এখনও কোন সরকারি চিঠি বা আবেদন বাংলায় লেখাটা বাধ্যতামূলক করা গেল না সে প্রশ্নের উত্তর সরকারের কোন দপ্তরের কাছেই নেই।

কেন এ রাজ্যের সব দোকানের নাম বাংলায় হবে না তা নিয়েও কারোর কোন মাথা ব্যথা নেই।এখনও আইন আদালতের যাবতীয় কাজ হয় ইংরেজিতে।আমাদের আইনজীবীরা ভুল ইংরেজিতে আইন বোঝান লেখা পড়া না জানা গ্রাম্য মানুষজনকে।বাংলা ভাষাকে আমরা অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে জুড়তে কোন প্রয়াস করিনি,ইংরেজি বা হিন্দি না জানলে চাকরি পাওয়া সমস্যা হতে পারে তাই আমাদের বাংলা মিডিয়াম স্কুল গুলো প্রায় উঠে যেতে বসেছে।

সবাই ইংরেজি মাধ্যমে ভিড় জমাচ্ছেন,সরকারি স্কুল এমনকী পুরসভা দ্বারা চালিত স্কুলও এখন ইংরেজি মাধ্যম করে দেওয়া হচ্ছে।ফলে বাংলা ভাষা সরকারি অবহেলার শিকার।সেই ভাষা পিছু হটছে,সেই ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বলতে না মানুষগুলো হিনমন্যতায় ভুগছে,তারা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে,সব জায়গা থেকে সরে একান্তে প্রান্তবাসী হয়ে পড়ছে।

বাংলা ভাষাই তো ধারণ করে বাংলা সংস্কৃতিকে।আর ভাষাই যখন দিন্দি আগ্রাসনে ক্রমশ পিছু হটছে তখন বাংলা সংস্কৃতি যে ভেঙে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী!বাংলা বাঙালি যে মিলে মিশে বেধেঁ বেধেঁ থাকার কথা বলতো আজকের প্রজন্ম তা ভুলে গেছে।বাঙালি সংস্কৃতির সেই একান্নবর্তী পরিবার,যেখানে অনেকের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার রেওয়াজ ছিল,যে পরিবারে মা বাবার পাশেই ঠাকুরমা,ঠকুরদাদা,পিসি কাকা ন জেঠি বা ফুল দিদিরা থাকতো তারা সবাই কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ রাজ্যের শহর অঞ্চলের সব পুরনো বনেদি বাড়ির দখল চলে গেছে হিন্দিভাষি মাড়োয়ারিদের দখলে।সেই সব বাড়ি এখন ব্যবসায়িক কেন্দ্র,ব্যবসা আর পানপরাগের গন্ধে হারিয়ে গেছে আমাদের একসময়কার বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা,তার মেধা আর মননের গর্ব।এখন সবটাই প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে তাড়িত।গান বাজনা সাহিত্য সব বাজারের নিয়মে চলছে এখন।যে বাঙালি ছেলে বা মেয়ে তার মনের মাধুরি মিশিয়ে একান্তে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে কবিতা লিখত আর তা লিখে গোপনে রেখে দিত বিছানার নীচে।সেই সব চাপা পড়া অনুভূতি এখন ফালতু অচল বলে গন্য হয়।আজকের প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বাবা মাকে একলা ফেলে বিদেশে বা অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়ে নিজেদের উন্নয়নের দাবি করে।

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় এখন আর কোন বাঙালি ছেলে মেয়েই মাথায় তুলে নিতে চায় না তারা চায় কেরিয়ারের চুড়ায় চড়তে।আর এরা জানে বাঙালি কেউ সেই ঠিকানা দিতে পারবে না দিতে পারে মারোয়ারি ব্যবসাদার,যারা বলে,’আরে ইয়ার বেঙ্গলমে হ্যায় কেয়া চলা যাও বাহার বহুত কুছ মিলেগা।’সত্যিই তো বাংলার দখলই যখন আর বাঙালির হাতে নেই তখন বাংলায় থেকে হবে কী! বাংলা এভাবেই পিছু হটছে পেছিয়ে পড়ছে।হিন্দি আগ্রাসনের এই বহর চলতে থাকলে বাংলা শুধু নামেই বাংলা থাকবে বাংলার অস্তিত্ব বিপন্ন কারণ বাঙালি বোধ হারাচ্ছে এটা বোঝার সময় এসে গেছে।

বাংলা যে ক্রমশ পিছু হটছে তা এ রাজ্যের রাজনীতি দেখলেও বোঝা যায় যে ভাষা ও ভঙ্গি রাজনীতিতে এখন ব্যবহার হচ্ছে তা ভাবা যায় না।বিজেপির নেতারা এখনও তাদের কর্মীদের কার্য়কর্তা বলে পরিচয় দেয় অথচ বাংলায় কার্যতকর্তা নয়,কর্মী বা সভ্য এই কথাটা ব্যবহার করা উচিত নেতারা আসলে দিল্লির সংস্কৃতি চালু করতে চান কিন্তু বাংলা বাঙালি যে আলাদা সংস্কৃতির দ্বারা চালিত সে কথা কেউ মনে রাখছেন না।

বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে পারেন গ্রাম বাংলার গরীব খেটে খাওয়া মানুষ।বাংলা বেঁচে আছে এখনও গ্রামের উঠোনে,গ্রামের আটপৌঢ়ে চৌহদ্দী এখনও বাংলার পাহাড়াদার।এখনও সেখানে সপিংমল আর পানপরাগের সংস্কৃতি ঢুকতে পারে নি,গ্রামের মানুষই অখনও বিনা হিনমন্যতায় বাংলা বলে না বলে তাদের উপায় নেই পরস্পরকে বুঝতে জানতে এই ভাষাই যে তাদের সম্বল তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইতে হয়তো গ্রাম বাংলাই আবার পথ দেখাবে।হিন্দি আগ্রাসনে চাপে থাকা বাঙালির কাছে এটাই একমাত্র আশার কথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here