দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শিলং, মেঘালয়ের পাহাড় ঘেরা,তুলির টানে আঁকা ছবির মতো এই শহরই ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র প্রেক্ষাপট। আপাতত সেই শিলং এখন বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম চর্চাস্থান হয়ে উঠেছে। চিটফান্ড কাণ্ডে সেখানে সিবিআই জেরা করছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে।
সারদা কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূলের প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষকেও সেখানে ডেকেছেন গোয়েন্দারা।

জামিনের শর্ত মেনে সাংবাদিক থেকে সাংসদ হওয়া কুণালও পৌঁছে গিয়েছেন শৈল শহরে। শনিবার দুপুরেই মেঘালয়ে নেমে গাড়িতে শিলং-এর উদ্দেশে রওনা দেন ‘এক ফোনে এক লাখ’-এর হোস্ট। আর যেতে যেতেই গাড়িতে বসে মেঘালয়ের মেঘলা আকাশ এবং পাহাড়ি রাস্তা,শীতসন্ধের শিলং। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্পর্শলাগা সেই বাড়ি, জিৎভূমি। এখানে বসেই রক্তকরবী, শিলংয়ের চিঠি, আরও কিছু। পাহাড়ি শহরতলীর পুণ্যভূমি। বাড়ির কেয়ারটেকার সুলতান মামুদ ছেলেটি বেশ ভালো। ঘুরিয়ে দেখালো। হাল্কা বাঁকা চাঁদের আকাশের নীচে কবিগুরুর

স্মৃতিবিজড়িত প্রাঙ্গণে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ধন্যছবি,এ সবের ছবি তুলে পোস্ট করেন ফেসবুকে। ক্যাপশনের প্রথম লাইনে লেখেন, ‘শিলং পাহাড়। আসছি।’ কিন্তু জেরার আগেই রাজনৈতিক মহলে জল্পনা বাড়িয়েছে তাঁর দ্বিতীয় লাইন। যেখানে তিনি লিখেছেন,‘লাবণ্য, শুনতে পাচ্ছ?’ প্রসঙ্গত, শেষের কবিতার অন্যতম চরিত্রের নাম লাবণ্য। কিন্তু এখানে কাকে লাবণ্য বলতে চাইলেন কুণাল? প্রাক্তন সাংসদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে সেই ব্যাখ্যা না দিলেও, অনেকেই নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করতে শুরু করে দিয়েছেন। সারদা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে কুণালকে গ্রেফতার করেছিল রাজ্য সরকারের গঠন করা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট)। যার মাথায় ছিলেন বিধাননগরের তৎকালীন পুলিশ কমিশনাররাজীব কুমার। জামিন পাওয়ার পর যতবার সিবিআই কুণালকে ডেকেছিলেন, নির্দিষ্ট সময়ে সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। গোয়েন্দাদের তিনি নাকি পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছিলেন, রাজ্য পুলিশের নেতৃত্বে থাকা সিট, সারদার অনেক নথি লোপাট করে দিয়েছে। বারবার তিনি নাকি সিবিআই-এর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্তাদের মুখোমুখি বসানোর। রাজীবের পর কুণালকে ডাকায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এ বার হয়তো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কুণাল জেলে থাকার সময় যখন আদালতে হাজিরা দিতে আসতেন, তখন বারবার সুর চড়াতেন রাজ্য পুলিশ এবং শাসক দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে। ব্যাঙ্কশাল আদালতের বাইরে এমনও বহুবার দেখা গিয়েছে, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কুণাল যখন প্রিজন ভ্যানে ওঠা বা নামার সময় কথা বলতেন, তখন অভিনব স্টাইলে তা রুখে দিত পুলিশ। গাড়ির টিন বাজিয়ে আর মুখে হা রে রে রে শব্দ করে এমন পরিবেশ তৈরি করা হতো, যাতে কুণালের কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে না পায়।

সেই কুণাল এখন জামিনে। তাঁর জামিনের অন্যতম শর্তই তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে। তাই সিবিআই নোটিস দেওয়ার পর মেঘালয় যাওয়া নিয়ে দু’বার ভাবেননি একদা দিদি-ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক। পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ আগেও জানিয়েছেন তিনি। বিধাননগরের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষের বিরুদ্ধে কুণালের ক্রোধ তো সীমাহীন। কিন্তু কোন লাবণ্যকে তাঁর শিলং যাওয়ার কথা শোনাতে চাইলেন কুণাল? জল্পনা কিন্তু রয়েই গেল। সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে দিল্লি থেকে আরও একটি বিশেষ টিম পাঠানো হয়েছে। যে অফিসাররা শুক্রবার সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে রিপোর্ট করেছেন। সম্ভবত শনিবার রাতেই তাঁরা পৌঁছে যাবেন শিলংয়ে। চিটফান্ড কাণ্ডে তদন্তের গতি বাড়াতে দু’দিন আগে দশ জনের একটি টিমকে কলকাতায় পাঠিয়েছিল সিবিআই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে শনিবার শিলংয়ে সিবিআইয়ের দফতরে কলকাতার পুলিশ কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হয়েছে। শুক্রবার তাঁর সঙ্গে শিলংয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, কলকাতা পুলিশের আরও দুই কর্তা জাভেদ শামিম ও মুরলীধর শর্মা। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের তরফে আইনজীবীরাও রয়েছেন বলে খবর। তবে সূত্রের খবর, এ দিন সিবিআই দফতরে পৌঁছোনোর পর এজেন্সির অফিসাররা জাভেদ শামিম ও মুরলীধর শর্মাকে বলেন, রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অনেক সময়, তাঁরা বাইরে অপেক্ষা করতে পারেন। আইনজীবীদেরও ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।


কেন্দ্রীয় এই তদন্ত এজেন্সি যে সব দিকে গুছিয়েই জিজ্ঞাসাবাদে নামছে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল বৃহস্পতিবারই। কারণ, রাজীব কুমারের পাশাপাশি তাঁরা জেরার জন্য শিলংয়ে ডেকেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষকে। এ দিন দুপুরে মেঘালয়ে পৌঁছে গিয়েছেন কুণাল। শিলংয়ের পথে রওনা হয়েছেন তিনি। সিবিআই সূত্রের খবর, রবিবার রাজীব কুমার ও কুণালকে মুখোমুখি বসানো হতে পারে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই শিলংয়ে নতুন টিম পাঠানোর বন্দোবস্তও চলছে কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে। কারণ, হতে পারে তখন নতুন টিমের গোয়েন্দা তথা দুঁদে অফিসাররা উপস্থিত থাকবেন। সিবিআইয়ের একটি সূত্রের দাবি, এ দিন সিবিআই দফতরে পৌঁছেই রাজীব কুমার সিবিআই কর্তাদেরজানিয়েছেন, তাঁর কাছে যা জিজ্ঞাস্য রয়েছে তা সিবিআই যেন শনিবার ও রবিবারের মধ্যেই শেষ করে ফেলে। কারণ, কলকাতায় তাঁর কাজের চাপ রয়েছে। তবে তার কোনও জবাব মেলেনি সিবিআইয়ের তরফে। রাজনৈতিক শিবিরের অনেকের মতে, বিষয়টি এখন সিবিআই ও কলকাতা পুলিশের মধ্যে কার্যত ইগোর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ, সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের গত রবিবার কলকাতা পুলিশ যে ভাবে হেনস্থা করেছে ও টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলেছে তাতে এই এজেন্সির শীর্ষ সারির কর্তারা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। বিষয়টি এই কেন্দ্রীয় এজেন্সির কাছে গরিমারও প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ফলে চিটফান্ড তদন্তে সব রকম ভাবে গতি বাড়ানো হয়েছে।

শুক্রবারই কলকাতায় সিবিআই দফতরে এক চিটফান্ড সংস্থার কর্ণধারকে ডেকে জেরাও করা হয়েছে বলে খবর। অর্থাৎ ব্যাপারটা শুধু রাজীব কুমারকে জেরা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সামগ্রিক ভাবে চিটফান্ডের তদন্তের জন্যই ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই কেন্দ্রীয় এজেন্সি। প্রসঙ্গত, এর আগে কুণাল বহুবার অভিযোগ করেছেন যে চিটফান্ড কাণ্ডে তাঁকে ফাসিয়েছে রাজ্য সরকার তথা পুলিশ। শুধু তা নয়, তিনি বার বার অভিযোগ করেছেন যে চিটফান্ড সংক্রান্ত প্রচুর নথিপত্র, তথ্য ও প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে।

বিধাননগরের প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষের বিরুদ্ধেও এ ব্যাপারে বারবার প্রকাশ্যে আঙুল তুলেছেন তিনি। সিবিআই কর্তাদের জেরায় সে সব কথা তিনি জানিয়েওছিলেন। কুণালের সেই সব জবানবন্দি রেকর্ড করেও রেখেছে সিবিআই। সম্ভবত এ বার জেরার সময় সেখান থেকেই ফের প্রসঙ্গ টেনে আনা হবে।

চিটফান্ড কাণ্ডের তদন্তে নেমে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে প্রথম দিনেই ম্যারাথন জেরা করলেন সিবিআই গোয়েন্দারা। সকাল পৌনে ১১ টার সময় সিবিআই দফতরে ঢুকেছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। সেখান থেকে বেরোন সন্ধ্যা সওয়া সাতটা নাগাদ। সিবিআই সূত্রে জানানো হয়েছে, কাল ফের সকাল সাড়ে দশটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে রাজীব কুমারকে।এ দিন রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদের মাঝে অবশ্য মধ্যাহ্নভোজ ও বিকেলে চা-এর বিরতি দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের দুপুরের খাবার নিয়ে তাঁর দুই সহকারী পুলিশ কর্তা জাভেদ শামিম ও মুরলীধর শর্মা সিবিআই দফতরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সিবিআই দফতরের মধ্যে একটা ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ এবং চায়ের জন্য রাজীববাবুকে ‘অফার’ করা হয়েছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here