অশোক মজুমদার

সেই চিরচেনা আত্মপ্রত্যয়ী বক্তৃতার ঝাঁঝ। ঝকঝকে রাজনৈতিক বোধ। কোথাও এতটুকু মরচে নেই। সমাজের প্রতি সেই একই স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মনে করাচ্ছে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

আমার মনে হয়, এই মুহুর্তে ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে আগামী প্রজন্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অভিষেক। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অভিষেক ওঁর মার্জিত ব্যবহার ও শানিত বাচনভঙ্গির মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে অভিষেকের ভাষণ ছিলো স্বল্প সময়ের। কিন্তু ওর অগ্নিকন্ঠ বক্তৃতায় ছিলো সেদিনের অগ্নিকন্যার মত তেজ।

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহু আঞ্চলিক দল গঠিত হয়েছে। কিন্তু একটা সময় পার করে দলগুলোর নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। ফলে রাজনীতির ময়দান থেকে তারা ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এমন উদাহরণ বহু। অভিষেক সেই ধারার বদল আনছে।

গত একুশের নির্বাচনে ওর গোছানো ক্যাম্পেন মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছে। মেদহীন, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, ও লম্বা রেসের ঘোড়া। দেশের অন্যতম বিজেপি বিরোধী মুখ তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যাঁর সম্পর্কে পিসি, সেই ব্যক্তিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল যে ভুগতে হবেই তা আজকাল ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও জানে। অভিষেককে তাই সব ধরণেরই রাজনৈতিক হেনস্থা সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। তবুও ওর আত্মবিশ্বাস একটুও টাল খায়না দেখে আমি অবাক। উল্টে অবিকল পিসির মতোই সিংহগর্জনে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়েন।

“যে রাজ্যে যাবো, সেই রাজ্যই দখল করবো।”….একটা আঞ্চলিক দলের সদস্য যখন একথা বলেন, বোঝা যায় দম আছে কতটা। অভিষেক মাত্র একমাসের মধ্যেই ত্রিপুরা সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু , তারপর তাঁর মেয়ে ইন্দিরা ও ইন্দিরার নাতি রাহুলকে অনেকেই বর্তমান রাজনীতির আইকন ভাবেন। রাজনৈতিক স্ট্রাগল সেভাবে করতে হয় নি। কিন্তু এটাও ঠিক, স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সমাজ গঠনে এই পরিবারের অবদান অপরিসীম। ফলে ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্রে গান্ধী পরিবারের নাম শুধু দেশ নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ওজনদার। তাই দেখতে গেলে সোনার চামচ মুখে দিয়েই রাহুলের জন্ম।

সেদিক থেকে অভিষেকের লড়াই ছিলো অত্যন্ত অসম। যাঁর সূত্রে ওর রাজনীতির আঙিনায় পা রাখা, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন একজন অতি সাধারণ মেয়ে। দিন আনতে পান্তা ফুরোনো, খালের পাশে টালির ছাউনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজা একটি পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়েটির দাদার ছেলে অভিষেক।

আমার সৌভাগ্য যে আমি দিদির পাশাপাশি ছোটো থেকেই অভিষেককে দেখেছি। দিদিকে বারবার আক্রমনে কখনো মাথা ভাঙা, কখনো হাত ভাঙা রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে অভিষেক তখনই দেখতাম একা একা জবাব চাইতো পতাকা হাতে। বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির সামনে মিছিল করতো। দিদির ধমকও খেতো। ঠাকুমা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোলে বসে থাকা সেই ছোট্ট অভিষেককে আমরা চিত্র সাংবাদিকরাও অনেকসময় সরিয়ে দিতাম। আজ ওর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বর্তমান ভারতের মধ্যে সবথেকে সম্ভাবনাময়। এই কারণেই রাহুল গান্ধীর থেকেও ও বহুযোজন এগিয়ে।

এই অভিষেক যখন রাজনীতিতে এলো তখন অনেক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজের বহু মানুষ কটূক্তি করতো। ওকে পাত্তা দিতো না। তারা মনে করতো অভিষেকের থেকেও অনেক লোক আছে এক দলে যাঁরা অনেক মাপকাঠি বিচারে অনেক বেশি যোগ্যতা রাখে দল পরিচালনায়। স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই, আমিও শুরু শুরুতে একটু সন্দিহান ছিলাম। মনে হতো, ও কি পারবে ?

কিন্তু সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে তৈরি করে কিভাবে ধীরে ধীরে মেলে ধরলো তা আমরা ২০২১এর বিধানসভা ভোটে প্রমান পেয়েছি। এখন তো প্রতিটা সময়ই দেখতে পাই কি নিপুনভাবে ও নিজেকে বেঁধেছে। ওর বজ্রগর্জন ভাষণ যখন শুনি তখন আমার মনে হয় এরকম গলা, এরকম বক্তব্য আমিতো এই সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শুনতাম। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের ভার্চুয়াল সভাতেও ও যেভাবে ত্রিপুরা সহ সারা দেশের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছিলো তা দেখতে দেখতে হুবহু দিদিকেই মনে পড়ছিলো।

বরঞ্চ এটা বলাই যায় অভিষেক আরও অনেক বেশি গুছিয়ে কথা বলে। যারফলে এই নির্বাচনের পরে গ্রামবাংলার মানুষও ওকে পছন্দ করে, ওকে ভালোবাসে। আমি তো বলবো, এই মুহূর্তে ভারতের যুবনেতাদের মধ্যে অভিষেকের নাম প্রথমেই থাকবে। কারণ ওরমধ্যে অদ্ভুত একটা প্রবীণ নবীন মেশানো দৃষ্টিকোন রয়েছে যা ওর একটি বিশেষ গুন। বাংলা, ইংরাজি,হিন্দি, পাঞ্জাবি, উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলা ছাড়াও ওর বাচনভঙ্গি, হাঁটাচলা, প্রেজেন্টেশন মানুষের মধ্যে ভীষণ সারা ফেলছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষ ভবিষ্যতের একজন যোগ্য নেতা পেতে চলেছে।

আসলে নেতা তৈরি করা যায় না। সে জন্ম নেয় মানুষের মধ্যে। মানুষই নেতা বানায়। অভিষেক হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো। নিশ্চিত সে ছোটো থেকেই রাজনীতির পরিসরে বড়ো হওয়ার জন্যই মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় অনেক সাবলীল। কিন্তু শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয় রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাঠে। এখানে নিরন্তর স্নায়ুর যুদ্ধ চলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে। সাহস, সংযম ও মানুষের প্রতি একাত্মতা না থাকলে রাজনীতি কাওকে গ্রহণ করে না। ছুঁড়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে কাগজ ছোঁড়ার মত।

অভিষেক সেখানেই আলাদা। ওর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যা যা গুন রয়েছে তাকে ও আরও পালিশ করেছে নিজের মতো করে। ফলে এখন ও নতুন যৌবনের দূতের মত টগবগ করে ফুটছে আগামীর বার্তা নিয়ে। দিদির ব্যাটন যোগ্য ব্যক্তির জন্যই অপেক্ষা করছে।

আমি দিদিকে দেখেছি দাপিয়ে বেড়াতে বাংলা তথা দিল্লীর দরবারে। আজ তাঁরই উত্তরসূরী অভিষেককে দেখছি জাতীয় ক্ষেত্রে। দিদির স্বপ্নের দলকে ও একটু একটু করে নতুন ঘাসফুল পুঁতছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অভিষেক আমার সন্তানসম। ছোট্টবেলা থেকে দেখছি। আমি আশীর্বাদ করছি ও যেন ওর দিদির(অভিষেকও দিদিকে দিদিই বলে) বহু আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা আদর্শকে দেশের কোনায় কোনায় বাস করা মানুষের মনের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here