স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়: সূর্যের উত্তরায়ণ শুরুর সাথে কিশলয়ের দল আড়মোড়া ভেঙে শীতের জড়তা সরিয়ে প্রকৃতির বুকে রঙিন বসন্তের আহ্বান জানায়। তখনই প্রকৃতির সাথে সাযুজ্য রেখে বসন্ত উৎসবের আয়োজন। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এই একমাত্র উৎসবে ধর্মীয় অনুষঙ্গ গৌন হয়ে গেছে মানুষের উৎসব মুখরতার কাছে। সেদিক থেকে দেখলে একমাত্র সর্বজনীন সর্বভারতীয় উৎসব যাতে ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের বিভেদটা আবীরের রঙে ঢাকা পড়ে যায়।
তাইতো আবার বসন্তের রং মাখার সময় এসেছে। আনন্দোৎসবে যেন খামতি না পড়ে। কিন্তু করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া নয়। সব মাথায় রেখে দেশ জুড়ে চলছে পালন রং এর উৎসব। অতিমারির বেরঙা দিনগুলো ভুলিয়ে দিল এই উৎসবের রং।
আম্রমুকুল, বেগনি রঙের বোগেনভোলিয়া আহ্বান জানাচ্ছে বসন্তের। প্রকৃতি সেজে উঠেছে আর তাকে উসকে দিতে ,খেলা হবের পরিবেশে বসন্ত এসেছে আর তাই প্রকৃতির রঙে রঙ মিলিয়ে নিতে এদিন প্রস্তুত ছিল বনগাঁবাসীও৷ সকাল থেকেই অভিযান,শক্তিগড়, আমলাপাড়া সহ শহরের বিভিন্ন পাড়ার থেকে দলে দলে মানুষ বেড়িয়েছেন রাস্তায়, নাচ, গান আর কবিতায় ভরিয়ে তুলেছেন যশোর রোড থেকে মণীষাঙ্গণ।
রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রী সোমা দেবনাথ রবী ঠাকুরের বসন্তের গান – নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো…মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করলেন এদিন৷ তাঁর কথায় এবছর রবীন্দ্রভারতীতে বসন্ত উৎসব বন্ধ, খুব মন খারাপ সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের, তাই সকলের জন্য এই বসন্তের উপহার নীল দিগন্তে… । দেখুন ভিডিও:
বাংলাদেশে যা ‘দোলযাত্রা’, ওড়িশায় তা ‘দোলোৎসব’, মহাভারতীয় যুগে ও উত্তর ভারতে ‘হোলি’ বা ‘হোরি’, কোঙ্কন আর গোয়ায় ‘শিমাগা’, দক্ষিণ ভারতে এই উৎসবের নাম ‘মদন দহন’ বা ‘কামায়ন’। নামের এত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও উৎসবের আঙ্গিকটা সর্বত্রই সমান। চাঁচর বা বুড়ির ঘর পড়ানো, রঙ মাখানো, নৃত্য গীতের মাধ্যমে নারী পুরুষের বাঁধাহীন মেলামেশা – উৎসবের অনিবার্য উপকরণ হিসেবে স্বীকৃত। হোলি -পার্বণের দোলযাত্রা, কামায়ন, শিমাগা, মদন – দহন প্রভৃতি নামগুলি এই উৎসবের চরিত্র নির্দেশক।
ধর্মের ভাবনা সরিয়ে সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে একে বসন্ত ঋতুর উৎসব বলে গণ্য করা হবে। শস্যকেন্দ্রিক উৎসব হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও কোনো কোনো পণ্ডিত হোলিকে নতুন বছরের সূচনা সম্পর্কিত উৎসব রূপে গণ্য করেছেন। কেননা, ভবিষ্যপূরাণ মতে ফাল্গুন মাস ছিল বছরের শেষ মাস। হোলি উপলক্ষে আগুন জ্বালিয়ে ‘বুড়ির ঘর’ বা ‘মেড়ার ঘর’ পোড়ানোর প্রথা অবলম্বন করে কেউ কেউ একে নববর্ষের সূত্রপাত বলে মনে করেন। কিন্তু এই উৎসব ফসল উৎসবের দ্যোতক। হোলির অগ্ন্যুৎসব সম্ভবত শস্যদেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদনের মাধ্যম।
ঐ আগুনে যে সব নিবেদন করা হয়, সেগুলি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পরেরদিন শসৃক্ষেত্রে ছড়ানো বা প্রসাদ হিসেবে গ্ৰহণ করার রীতি লক্ষ্য করা যায়। স্পষ্টতই এই রীতি ‘জুম্’ চাষের প্রথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কৃষি কেন্দ্রিক সংস্কারের সাথে উর্বরতা কেন্দ্রিক ধর্ম সংস্কারের দিকটিও বিদ্যমান। হোলি উপলক্ষে যে ধরনের সামাজিক ছাড়পত্র নিতান্ত রক্ষণশীল গ্ৰামীণ সমাজেও নারী-পুরুষের হাতে দু’একদিনের জন্য তুলে দেওয়া হয়, তাতে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বসন্ত উৎসব উপলক্ষে নারী -পুরুষের অবাধ অবাধ মেলামেশার রীতি সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচলিত, সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। উত্তর ভারতে হোলি উপলক্ষে নারী পুরুষের নকল মারামারি ও আসল মাতামাতির রেওয়াজ এর সাপেক্ষে যুক্তি দেয়।
এরই আর এক প্রকাশ চাঁচরের ছাই সরিয়ে পদ্মের আল্পনা আঁকা ও ছাইমাটি দিয়ে ‘গৌরী’ গড়ে পূজা করার আঞ্চলিক প্রথায় সমাজ বিজ্ঞানীরা নারীত্ব সঙ্কেত ও নারীসূচক চিহ্নের ইঙ্গিত করে যা, মদনোৎসবের রূপক। এটিই দ্রাবিড় বলয়ে ‘কামায়ন’।
হোলিতে লাল ও সবুজ রং স্পষ্টতই তারুণ্য ও যৌবনোৎসবের দ্যোতনা বহন করে। মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে এই দুটি রঙ কামনার ব্যঞ্জনাবাহী ও যৌবনের অনুভূতি সঞ্চারী। তাই রঙ মাখানো এক ধরনের প্রচ্ছন্ন যৌনাচার হিসেবে গণ্য। সুতরাং হোলি যে আদিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট যৌনাচার ভিত্তিক উৎসব, তথা মদনোৎসব এবং উর্বরতা কেন্দ্রিক ধর্মধারার সমন্বিত বিবর্তন, তাতে বোধ হয় সন্দেহ করার বিশেষ কিছু থাকে না।
বাংলাদেশে হোলি যে দোলে রূপান্তরিত হয়েছে তার পিছনেও এই ধারণাটি প্রচ্ছন্ন আছে ; বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে রাধা কৃষ্ণের রাসলীলা ও হোলি বসন্ত উৎসবে সমন্বিত হয়েছে। বাঙালীর যেহেতু ‘কানু ছাড়া গীত নেই,’ তাই রাধা কৃষ্ণের দোলের ব্যঞ্জনায় রক্ষণশীল বাঙালি সমাজমনে প্রতিভাসিত। রাধা কৃষ্ণের ‘দোলায় গমন’ কথাটি এখানে সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দোলা থেকেই ‘দোল’ শব্দটি এসেছে। কবি মলয় গোস্বামীর বিশ্লষণে দোল তথা দোলনাকে ঋতুচক্রের আবর্তনের সঙ্গে তুলনায় বলা যায়, ” … শিবের গম্ভীর, স্তদ্ধ তপস্যা যদি শীতের প্রতীক হয়, তাহলে মদনের পুস্পশর সন্ধান হল বসন্তের সূচনা। লোকপুরাণ বৃত্তের ‘nature mith’ – টি কালপর্যায়ে ধ্রুপদী পৌরাণিক বৃত্ত পরিনত হয়েছে। ” তাই বসন্ত ঋতু এবং নতুন বছর সমীকৃত বলেই গণ্য হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। নতুন ঋতুর এই দোলাচল আবির্ভাব উপলক্ষে মানুষের আনন্দোৎসব ‘দোল’ বলে গণ্য। আর বসন্ত উৎসবে রঙিন পুস্পরেণু মাখানো হয় বলে এ উৎসব ‘ফাগোয়া’ বলেও পরিচিত হয়েছে কালক্রমে।
বৈষ্ণবভাবানুসারে হিরণ্যকশিপুর ভগ্নীয হোলিকা দানবীর আগ্নিদাহনের কাহিনী চাঁচরের সঙ্গে একাকার করে বৈষ্ণব ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে রাধাকৃষ্ণের দোল লীলা প্রসারের প্রেক্ষিতে।
মদন দাহনের যে ভাবানুষঙ্গ দোলোৎসবের মধ্যে সুস্পষ্ট, ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে শিব-পার্বতীর মিলনও অভিব্যঞ্জিত। একই সঙ্গে বৈষ্ণবীয়, শেব ওবং শাক্ত তিনটি প্রধান ধর্মধারা এর মধ্যে বিমিশ্রিত হয়ে গেছে। নতুন রবি শস্যের আসন্ন প্রত্যাশা, বাসন্তিক যৌবন উৎসব এবং হয়ত নতুন বছরের আহ্বান ; এই সবকিছু দোল যাত্রার মহোৎসবের মধ্যে সমারুঢ় হয়েছে।