তবছর ডিসেম্বর থেকেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, চিনদেশে কী একটা নতুন রোগ এসেছে, খুব ছোঁয়াচে। সেই রোগটা যে বাড়তে বাড়তে গোটা পৃথিবীকে ঘরবন্দি করে ফেলবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। এমনকী জানুয়ারিতে হু যখন সতর্কবার্তা প্রচার করল, বিশ্ব জুড়ে অতিমহামারী ছড়িয়ে পড়তে চলেছে, তখনও অনেকে হাসিঠাট্টা করছিল। শেষকালে ২৫ মার্চ লকডাউন জারি হতে মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসল ভয়।


২০২০ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনা নিঃসন্দেহে কোভিড অতিমহামারী। ১৯১৮ সালে এসেছিল স্প্যানিশ ফ্লু প্যানডেমিক। তার ১০০ বছর বাদে এল করোনা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অবধি যে হিসাব, অতিমহামারীর কবলে বিশ্ব জুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ। আক্রান্ত হয়েছেন সাত কোটির কাছাকাছি।
আমরা আগে জানতাম, সভ্যসমাজে মুখ ঢেকে চলাফেরা করা অশোভন। এবছর জানলাম, মাস্কে মুখ ঢেকে রাখাই হল সভ্য রীতি। নাক, মুখ ঢাকা থাকলে তবেই নিজে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, অন্যকে রক্ষা করা যায়।

লকডাউন ব্যাপারটা যে কী, তাও দু’টো-তিনটে প্রজন্মের মানুষ জানত না। আগে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল হলে ১৪৪ ধারা হত, কার্ফু হত, মানুষ ঘরে থাকতে বাধ্য হত। কিন্তু ভাইরাসের ভয়েও যে এইরকম ঘরে বদ্ধ থাকতে হয়, তাও এক-আধ দিন নয়, মাসের পর মাস, এ একেবারে আনকোরা অভিজ্ঞতা।
অনেকদিন ধরেই আসবে আসবে করছিল। বছরের শেষে এসেই পড়ল ভ্যাকসিন। আর কোনও রোগের বেলায় এত দ্রুত প্রতিষেধক বেরোয়নি। ১৯১৮ সালে ফ্লু প্যানডেমিক দেখা দেওয়ার পরে ভ্যাকসিন বেরিয়েছিল ১৯৪৫ সালে। পোলিও রোগটা ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছিল বিংশ শতকের শুরুতে। তার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় ১৯৩৫ সালে। তাও সেই ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স পেতে সময় লেগেছিল আরও ২০ বছর। এইডসের ভ্যাকসিন বার করার জন্য চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। এখনও কেউ সফল হয়নি।

বেশিরভাগ বছরেই ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গে আসব আসব করেও শেষ পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় বাংলাদেশের দিকে। এবার কিন্তু ক’দিন আগেই জানা গিয়েছিল, সুন্দরবনে আছড়ে পড়ার পরে সে কলকাতা পর্যন্ত ধেয়ে আসবে। সত্যি তাই এল। ঝড়ের নাম উমফান। তার সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে এসেছিল আয়লা। তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। অর্থাৎ উমফান ছিল আয়লার চেয়ে শক্তিশালী। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশি। একটা প্রশ্ন উঠছে, এবার থেকে প্রতি ১০-১১ বছর অন্তরই কি পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড়? জলবায়ুর পরিবর্তনেই কি এমনটা ঘটবে?


বছরের শুরুতে ছিল এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলন। শাহিনবাগে অবস্থানে বসলেন দাদিরা। ক্রমে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দেশ জুড়ে। স্বাধীনতার লড়াই হোক কিংবা বামপন্থী আন্দোলন, আগে কখনও গৃহবধূরা গণআন্দোলনের সামনের সারিতে থাকেননি।
করোনার প্রকোপ একটু কমতেই ট্র্যাক্টরে চড়ে, পায়ে হেঁটে দিল্লিতে উপস্থিত হাজার হাজার কৃষক। তাঁদের পণ, সরকার তিনটি কৃষি আইন বাতিল না করলে রাজধানী অবরোধ করে বসে থাকবেন। এই আন্দোলন ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাতে অস্বস্তি বেড়েছে সরকারের।

এবছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা আগেও অনেকবার ভারতে এসেছেন। কিন্তু এবছর নতুন যা ঘটল, তা হল, একজন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে দিল্লির দাঙ্গা। একজন অতিথি দেখে গেলেন, ভারতের রাজধানীও দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। খুবই লজ্জার ব্যাপার। লজ্জা ঢাকতে সরকার কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। বড় বড় চার্জশিটও দিয়েছে। কিন্তু শাসকদলের যাঁরা দাঙ্গার সময় ‘গোলি মারো শালোঁ কো’ বলে রাস্তায় ঘুরছিলেন, তাঁদের কেউ ছোঁয়নি।


অর্থনীতির দিক থেকে বলা যায়, বছরটা খুব খারাপ গেছে। এমনিতেই আর্থিক ক্ষেত্রে নানা টালমাটাল চলছিল, করোনা এসে আরও খারাপ অবস্থা করে দিয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী লকডাউন করলেন ঠিক চার ঘণ্টার নোটিশে। আচমকাই সব থেমে গেল। ভিন রাজ্যে যে শ্রমিকরা কাজ করতে যান, তাঁরা বেকার হয়ে পড়লেন। হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিককে পায়ে হেঁটে ফিরতে হল বাড়িতে। পথে মৃত্যু হল কতজনের।

লকডাউন বদলে দিয়েছে অনেকের পেশা। যাঁরা অটো-টোটো চালান অথবা বড়বাজারে দোকানে কাজ করেন, তাঁরা অনেকেই কাজ হারিয়ে পথের ধারে সবজি বেচতে বসেছেন।
অর্থনীতিতে যখন এমন মন্দা, তখন মুকেশ আম্বানীর সম্পত্তি বেড়েছে বিপুল। একটি হিসাব বলছে, মার্চে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে মুকেশ প্রতি ঘণ্টায় রোজগার করেছেন ৯০ কোটি টাকা। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ২ লক্ষ ৭৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি।


অতিমহামারী, ঝড় ও আর্থিক মন্দার মধ্যে মানুষের যতই দুর্দশা হোক, দেশে হিন্দুত্ববাদীদের অ্যাজেন্ডা পূরণে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অগাস্টে রামমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছেন নরেন্দ্র মোদী। লাভ জেহাদ নিয়ে আইন আসছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। যদিও বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে জানিয়েছে, লাভ জেহাদ বলে কিছু হয় না।

দেশের সবচেয়ে পুরানো দলটির হতশ্রী অবস্থা হয়েছিল অনেক আগেই। ২০২০ তে কংগ্রেসের দুর্দশা আরও বেড়েছে। বিহারের বিধানসভা ভোটে তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। হায়দরাবাদের পুরভোটে বিজেপিকে কার্যত ওয়াক ওভার দিয়েছে। দলের অবস্থা দেখে প্রবীণ নেতারা বিদ্রোহ করছেন।


এই বছরে কৃতিত্বও দেখিয়েছে কেউ কেউ। টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে সেরা কিশোরী বিজ্ঞানীর মর্যাদা পেয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত গীতাঞ্জলি রাও। চাঁদে নিজেদের পতাকা পুঁতে এসেছে চিন। গ্রহাণু থেকে খানিক নমুনা নিয়ে এসেছে জাপান।


এবছরটা তো প্রায় শেষ, নতুন বছর কেমন যাবে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ২০২০-র ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না ২০২১। ভ্যাকসিন এলেও করোনা যে একেবারে নির্মূল হবে তা নয়। সুতরাং মাস্ক পরতে হবে। মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ববিধি। এনআরসি ও দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভা ভোটে। উমফানের ত্রাণ নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, তারও প্রভাব ভোটে পড়া অসম্ভব নয়।

এই প্রথমবার বিরোধীরা শাসক দলের নেতা ভাঙিয়ে ভোটে জিততে চাইছে। এর পরিণাম কী হয়, সেদিকেও নজর থাকবে সকলের।
অতিমহামারী আসবে আবার ১০০ বছর আগে। আপাতত বহুদিন মানুষের মনে জেগে থাকবে করোনার স্মৃতি। আগামী দিনে এই ২০২০ সালের কথা উঠলেই সকলে বলবে, সে একটা বছর গিয়েছিল বটে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here