অশোক মজুমদার

যে কোন দুঃসময় মানুষের ভিতরের আমিটাকে বার করে আনে। তখন আমরা কোন সময় দেখি মানুষের মহানুভবতার ছবি, কখনও বা একটা স্বার্থপর দানবিক মুখ। করোনা আমাকে যেন লাগাতার এই ছবি দেখিয়ে চলেছে। বুঝতে পারছি কবি কেন লিখেছিলেন – ‘মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেরই মাঝে সুরাসুর।’ কেষ্টপুর থেকে নিউটাউন যাওয়ার পথে যেন উঠে এলো বিখ্যাত আলোকচিত্রী সুনীল জানার তোলা দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলার এক পুরনো ছবি! চারপাশে ঝকঝকে আলোকিত শহরের গালে এই ছবি যেন সপাটে একটা চড়! অবশ্য সংশ্লিষ্ট মানুষগুলি তাতে খুব একটা লজ্জা পাবেন বলে মনে হয়না। ব্যাপারটা একটু বিশদ করি।

গত দুদিন ধরে কেষ্টপুর থেকে নিউটাউন যাওয়ার পথে ২০৬ নম্বর ফুটব্রিজের পাশে আশা গার্ডেনের সামনে পড়ে আছেন বছর পঞ্চাশের এই মানুষটি। স্থানীয় দোকানদার জানালেন, দুদিন আগে মাঝরাতের দিকে অটোয় করে এসে মানুষটিকে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়। তখনও নিম্নাঙ্গে পরিধেয় ছিল, এখন নেই। হাঁটাচলা করতে পারেন না, বোঝা যায় মানসিক ভারসাম্যহীন। একটু রাগী, স্থানীয় দোকানিরা মাঝমধ্যে চা বিস্কুটও দিচ্ছেন। বিখ্যাত বাচিক শিল্পী শোভন সুন্দর বসুর স্ত্রী অদিতি বসু স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে মানুষটিকে দু-তিনবার দেখেও এসেছেন। জানানো হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলার এমনকি বিধাননগরের কমিশনারকেও। তারপরে সেই এক নাটক, থানা বলছে কাউন্সিলারকে বলুন, তিনি বলছেন আমার কিছু করার নেই। ‘চুপচাপ থাকুন, দেখা হচ্ছে’ বাণী দিয়ে কাউন্সিলার চুপ করে গেছেন। পরিত্যক্ত অবস্থায় পথেই পড়ে আছেন তিনি। স্থানীয় মানুষরা এ দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছেন না, করোনার ভয় তো রয়েইছে।

আমার কাছে এই ছবিটি পাঠালেন অদিতি বসু সহ স্থানীয় কিছু মানুষ। চুপচাপই ছিলাম, কতকিছু তো মেনে নিতে হয়! কলকাতায় আসার পর এ দৃশ্য আমার কাছে একেবারে অচেনা তাও নয়। প্রথমে ধাক্কা লাগতো, তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চালাকি রপ্ত করেছি। কিন্তু মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনা, যত বয়স বাড়ছে যন্ত্রণাও যেন ততই বাড়ছে। মাদার টেরিজা বেঁচে থাকাকালীন রাস্তায় পড়ে থাকা এমন বহু মানুষকে উদ্ধার করে কালীঘাটের নির্মল হৃদয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলায় আসা বিদেশী ছেলেমেয়েরা তাদের সেবাশুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুলছেন এমন বহু দৃশ্য আমি ক্যামেরাবন্দীও করেছি। সেই সেবাধর্মের ব্যাপারটা এখন বড়ই কম। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারেনা।

সত্যি বলতে কি কাজের কাজ নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় বচনবাজিই এখন বেশি। সেখানে উপস্থিতি জাহির করেই যেন আমাদের দায়িত্ব শেষ। আমি নিজেই বা কতটুকু করতে পারছি? করোনার ভয়ে মানুষ তো কুঁকড়ে যাচ্ছেন, এটা একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে থানা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা কিংবা পুর প্রশাসন কীভাবে চুপ করে থাকেন তা ভেবে আমার অবাক লাগে! তাদের কি কোন দায়িত্ব নেই! অদিতি বসুরা নিজেদের মত করে একটা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্যিই কতদূর যেতে পারেন তারা? একই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল লকডাউনের প্রথম পর্বে সেক্টর ফাইভে আটকে পড়া কল সেন্টারের কয়েকজন ছেলেমেয়েকে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়ে। স্থানীয় থানা, ক্লাব, এনজিও কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। আমি যাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলির কান্না ছাড়া কোন কথা ছিল না।

সুনীল জানার আলোকচিত্র বাংলার দুর্ভিক্ষ আর মন্বন্তরের এক জীবন্ত দলিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ আর চিত্তপ্রসাদের ছবি বাংলার সেই ফেলে আসা কালো সময়ের এক নিখুঁত মানবিক ছবি তুলে ধরে। আর এই ছবি দেখে আমার মনে পড়লো, যাত্রী তুলতে ব্যস্ত ভিড়ে ঠাসা প্রাইভেট বাসের কন্ডাক্টরদের কথা – পিছনে এগিয়ে যান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here