পার্থ সারথি নন্দী : আট মাস আগে ভোরের আলোর ফোটার আগেই দিন শুরু হত ওঁদের। স্নান সেরে পসরা গুছিয়ে নিয়ে স্টেশনে ছোটার পালা। কারও ঝাঁপিতে ঝালমুড়ির রকমারি, কারও ঝাঁপিতে মিষ্টি বা ডিমসেদ্ধ, কেউ বা আবার পসরা সাজাতেন চুলের ক্লিপ-কানের দুলে। কেউবা হরেক রকমের থালা বাসন,তারপর ট্রেনে উঠে বিকিকিনির পালা।
নিত্যদিনের যাতায়াতে সবাই প্রায় চেনা মুখ। চেনা সুরে যাত্রীরাও ঠিক চিনে নিতেন তাঁদের। এটাই জীবন চিত্র ছিল বনগাঁর সুকুমার দেবনাথ, দিলীপ রায়, সনাতন বিশ্বাসদের। গত আট মাসে যা থমকে গিয়েছিল। বুধবার থেকে চালু হবে লোকাল ট্রেন। তাই ফের চেনা ছন্দে ফেরার স্বপ্নে মশগুল রেলের হকাররা।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের জেরে পুরোপুরি থমকে গিয়েছিল ট্রেন চলাচল। আনলক পর্বে বিক্ষিপ্তভাবে মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেন চলতে শুরু করলেও বন্ধ লোকাল ট্রেন। তাই রেলে হকারি করে রুটিরুজির সংস্থানও বন্ধ হয়ে গেছিল। চারদিক থেকে যেন মাকড়সার মত ঘিরে ধরেছিল আর্থিক অনটন।
বুধবার থেকে ফের ট্রেন চলবে তাই একটু মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে বনগাঁর জয়পুর,নয়াগোপালগঞ্জ,চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর এলাকার রেল হকারদের৷ নয়াগোপালগঞ্জ এর বাসিন্দা তাঁর ঘটি গরমের আগুনে একটা জোরে ফুঁ দিয়ে বললেন, এতদিন রেশনে পাওয়া চাল, ডাল দিয়ে কোন মতে পাচঁ জনের সংসারে পেটভরিয়েছেন৷মঙ্গলবার রাতে বনগাঁ প্লাটফর্মের পাশেই অপেক্ষা করছেন বুধবারের প্রথম ট্রেনে আবার নতুন করে অর্থ উপার্জনের পথে ছুটবেন বলে।
কেউ কেউ সংসার চালানোর জন্য সাময়িক ভাবে বেছে নিয়েছিলেন অন্য পেশা।এখন তাঁরাই আবার ফিরবেন চেনা জীবনে৷পরিচিত পরিবেশে৷
বনগাঁর বিভিন্ন এলাকাতে প্রায় হাজারেরও বেশি রেল হকারের বাস। বনগাঁ থেকে শিয়ালদাগামী সমস্ত ট্রেনে দেখা মিলত এঁদের। কেউ ঝাল মুড়ি, কেউ রুমাল, কেউ বা ফল বিক্রেতা। দীর্ঘদিন ট্রেনে ওঠেননি তাঁরা। জিনিস বিক্রি করেননি। বুধবার থেকে ট্রেন চলার খবর শুনে শুধু ব্যক্তি নন খুশির হাওয়া বইছে তাঁদের গোটা পরিবারে। জমে থাকা ব্যবসার জিনিস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। তবে ট্রেনে উঠতে পারবেন কিনা তা নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা। আপাতত বুধবার সকালের দিকে তাকিয়ে সবাই।
পেশায় ফাইবারের থালা বাসন এবং বনগাঁর বিখ্যাত চিরুনি বিক্রেতা সুকুমার দেবনাথ বলেন, ‘‘গত কয়েকমাস ঘরে বসে থেকে পুঁজি সব শেষ হয়ে গেছে। এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছি সকাল থেকে রাত। তাতে কোনও রকমে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার বেচাকেনা হতো। ট্রেনে উঠতে পারলে হয়তো নতুন করে জীবন ফিরে পাব৷’’ দিলীপ রায় বলেন, ‘‘২০ বছর ধরে ট্রেনে ব্যবসা করছি একইভাবে। এমন হবে কোনও দিন ভাবিইনি। কীভাবে যে দিন কাটছে একমাত্র ভগবান জানেন।
ট্রেন চলবে আবার। এটা ভেবেই অানন্দ পাচ্ছি।’’বনগাঁ প্লাট ফর্মে ঘুগনী বিক্রি করেন সকলের পরিচিত চির দা, তার কথায় প্রায় কুড়ি বছর এই প্লাটফর্মে ঘুগনী বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি, এত দিন কাজ কর্ম বন্ধ ছিল ফের ফিরে পাব কাজের জায়গা তাই রাতেই চলে এসেছি স্টল পারিস্কার করতে। মঙ্গলবার রাতেই ট্রেনে চেপে বসেছিলেন উমা বিশ্বাস, রমা তরফদারেরা৷তাঁরা ফের বাবুর বাসায় কাজের ডাক পেয়েছেন, তাই প্রথম ট্রেনেই কলকাতায় পৌঁছাতে হবে যে।
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাত মাস পর গড়াতে চলেছে লোকাল ট্রেনের চাকা। বুধবার থেকে চালু হবে ট্রেন। তাই শেষমুহূর্তের ব্যস্ততা এখন বনগাঁ স্টেশন ও বারাসত কারসেডে। লোকাল ট্রেনগুলিকে ফের প্রস্তুত করা হচ্ছে যাত্রী পরিষেবার জন্য। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে অন্যান্য যন্ত্রাংশ মেরামতির কাজ।
মঙ্গলবার কারসেডে গিয়ে দেখা গেল রেলকর্মীরা ব্যস্ত প্রত্যেকটি ট্রেনের কামরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে। ট্রেনগুলির যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের পাশাপাশি রেল ট্র্যাকে পেনড্রাল ক্লিপে গ্রিজ লাগানো হচ্ছে। চাকা এবং গিয়ারবক্সে গ্রিজ লাগানোর কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে জীবানুনাশের কাজ। ট্রেনের প্রত্যেকটা আসনে ক্রস মার্ক করা হচ্ছে লাল স্টিকার দিয়ে। যাত্রীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রত্যেকটি কামরায় বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিতে পোস্টার লাগানো হচ্ছে। সেখানে কোভিড সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে।
বনগাঁ থেকে শিয়ালদা স্টেশনের প্রতিটি প্লাটফর্মে চলছে জোরকদমে প্রস্তুতি। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় লোকাল ট্রেন চালুর আগে সমস্ত কিছু দেখে নিচ্ছেন আধিকারিকরা। আরপিএফ ও জিআরপির তরফে খতিয়ে দেখা হচ্ছে প্রস্তুতি। বনগাঁ স্টেশনেও দেখা গেল আরপিএফ এবং রেলকর্মীরা যাত্রীরা কীভাবে ঢুকবেন বেরোবেন তা নিয়ে তদারকি করতে।
স্টেশনে ঢোকার এবং বেরোনোর গেট আলাদা করা হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে প্রত্যেক যাত্রীকে থার্মাল চেকিং করা হবে। এছাড়াও প্রত্যেকটি ট্রেনের কামরাতে বাংলা ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। যেখানে কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে। লোকাল ট্রেন চললেও প্রত্যেকটি ট্রেনেও যাত্রীসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানা গেছে। স্টেশনে অতিরিক্ত আরপিএফ এবং জিআরপি কর্মীদের মোতায়েন করা হবে ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য।