দেশেরসময় ওয়েবডেস্কঃ প্রস্তুত ছিলেন না নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশির ঘরে পৌঁছে যাওয়া বৃদ্ধা দুপুরের পর সংবাদমাধ্যম দেখেই জানতে পারেন তাঁর ছেলে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন । সঙ্গে পুত্রবধূ এস্থার ডাফলোও। তারপর এক ঘণ্টাও কাটেনি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ভিড় জমে যায় অভিজিৎবাবুর বালিগঞ্জের বাড়িতে। কোনওরকমে তৈরি হয়েই সোফায় বসে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিলেন নোবেলজয়ীর মা। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ছেলেকে হাতে ধরে সব কিছু শিখিয়ে দেওয়ায় তিনি বিশ্বাস করেননি কোনও কালেই। বললেন, “ও যা করেছে, যা করতে চেয়েছে, যে পথে এগোতে চেয়েছে, তাতেই আমার সায় ছিল।”

ছেলে নোবেল পেয়েছেন। মায়ের তো গর্ব হবেই। নির্মলাদেবী বললেন, “আমাকে অনেকেই বহুবছর ধরে বলেন, ও ভাল কাজ করছে। আজ ও তার যোগ্য সম্মান পেল।” বছরে তিন-চার বারের বেশি দেখা হয় না মা-ছেলের। মাঝে মাঝে এ শহরে আসার সুযোগ হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা গবেষকের। এ দিন নির্মলাদেবী বলেন, “ও তো প্রথমে ঠিকই করতে পারছিল না কী নিয়ে পড়বে। শুরুতে ভেবেছিল ফিজিক্স পড়বে। তারপর নিজেই বলল পড়বে না। ভর্তি হল স্ট্যাটিটিক্স নিয়ে। কিছু দিন ক্লাস করার পর বলল, বিটি রোডে যেতে আসতেই অর্ধেক সময় চলে যাচ্ছে। তারপর অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হল প্রেসিডেন্সিতে।” সেখান থেকে স্নাতক হওয়ার পর অভিজিৎবাবুর পড়াশোনা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর হার্ভার্ড।


পুত্রবধূ এস্থারের কথাও এ দিন জানান নির্মলাদেবী। বলেন, “অনেক দিন এস্থার এসে কলকাতায় ছিল। এই বাড়ি থেকেই বিয়ে হয়েছিল ওদের।” নির্মলাদেবী আরও বলেন, “ভারতের নতুন ট্যাক্স পলিসি নিয়ে আমার একটা কৌতূহল আছে। কোথাও বুঝতে অসুবিধে হলে ওকেই জিজ্ঞেস করি। ও আমায় বুঝিয়ে দেয়।” মায়ের চোখে ছেলের ইউএসপি টা ঠিক কী? মায়ের জবাব, “অভিজিৎ সহজ ভাষায় কথা বলে। যাতে সবাই বুঝতে পারে। লেখেও সেই ভাষায়। এটা ওর বড় গুণ।”
নোটবন্দির সময় অভিজিৎবাবু তীব্র সমালোচনা করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের। স্পষ্ট বলেছিলেন, এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হবে। মা জানালেন, “এই যে ব্যবস্থা চলছে, তাতে ওর মোটেই সায় নেই। তবে ওর কথা ওই ভালো বলতে পারবে।”

অর্থনীতিতে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির দিনেই ভারতের চলতি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের অন্যতম প্রিয় ছাত্র অভিজিৎবাবু। ছাত্রের লেখা ‘পুওর ইকোনমিকস: আ র‍্যাডিক্যাল রিথিংকিং অফ দ্য ওয়ে টু ফাইট গ্লোবাল পভার্টি’ পড়ে অধ্যাপক সেন বলেছিলেন, “দুর্দান্ত বিশ্লেষণ। একেবারে গভীরে গিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।” ১৯৯৮-এর পর ২০১৯। একুশ বছর পর নোবেল পেলেন কোনও বাঙালি। মাস্টারমশাই অমর্ত্য সেনের পর ছাত্র অভিজিৎ বিনায়ক। সেই অর্থনীতিতেই।

নোবেল জিতেই অভিজিৎ বললেন, ভারতের অর্থনীতির মন্দগতি উদ্বেগজনক

অর্থনীতিতে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির দিনেই ভারতের চলতি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এ দিন নোবেল কমিটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কয়েক প্রহর পরেই সংবাদমাধ্যমে প্রশ্নের জবাবে অভিজিৎ বলেন, সরকারের উচিত এমন নীতি নির্ধারণ করা, যা প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হবে। আগু-পিছু না ভেবে দুমদাম কোনও পদক্ষেপ করা ঠিক হবে না। গত পাঁচ বছরে গ্রামীণ অর্থনীতির মন্দগতি নিয়েও এ দিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।

বিশ্বজুড়ে দারিদ্র মোচনের লক্ষ্যে তাঁর গবেষণার জন্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে বলে সোমবার ঘোষণা করেছে দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। অভিজিৎবাবুর সঙ্গেই ওই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমার।

সুইডিশ অ্যাকাডেমির ওই ঘোষণার পরে সংবাদমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে অভিজিৎবাবু বলেন, “ভারতের অর্থনীতির এখন কিছুটা নড়বড়ে অবস্থা। সরকার যেসব নীতি নির্ধারণ করছে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে আগে পাইলট করে দেখা উচিত।”

অভিজিৎবাবু আরও বলেন, “আমার মনে হয় ভারতে কোনও নীতি প্রণয়নের সময় নেপথ্যে এই ভাবনা থাকে যে তা শুনতে বেশ ভাল লাগছে, কিংবা রাজনৈতিক ভাবে তা কার্যকরী হতে পারে।” তাঁর কথায়, “মোদ্দা ব্যাপার হল, কোনও নীতি বাস্তবায়নের আগে তা গভীর ভাবে হয়তো পর্যালোচনাই করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী কিছু একটা বলে দেন। ব্যস, ওটাই বাস্তবায়িত করা হয়।”

অভিজিৎবাবু যখন এ কথা বলছেন, তখন শুনে হয়তো অনেকেরই মোদী সরকারের নোটবন্দির সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাবড় অর্থনীতিকদের অনেকেই যে পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থনীতির পণ্ডিত মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, এ হল সংগঠিত লুঠ। এর জন্য আগামী কয়েক বছর ধরে অর্থনীতিকে ভুগতে হতে পারে।

প্রসঙ্গত, এ দিনই আবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন স্বীকার করে নিয়েছেন যে পণ্য পরিষেবা কর তথা জিএসটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি ছিল।

নোটবন্দি ও তার পর তাড়াহুড়ো করে জিএসটি ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে তা নিয়ে অনেকেই একমত।

তবে মনমোহন সরকারের কিছু প্রকল্পের এ দিন প্রশংসাও করেছেন অভিজিৎবাবু। বিশেষ করে রোজগার গ্যারান্টি তথা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের রূপায়ণ যে দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হয়েছে, তা মেনে নেন। তিনি বলেন, “একশো দিনের প্রকল্পের ফলে মানুষের শুধু তা থেকে আয়ই বাড়েনি, ওই প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য ন্যূনতম মজুরিও বেড়েছে।”

প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধী যে ইস্তাহারে ন্যূনতম রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন তার নেপথ্যে অন্যতম কারিগর ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন রাহুল। তা ছাড়া অভিজিতের স্ত্রী এস্থার ডাফলোর সঙ্গেও অতীতে কাজ করেছেন জয়রাম রমেশের মতো রাহুল-ঘনিষ্ঠরা।

এ দিন অভিজিৎবাবু বলেন, “প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনাও দারিদ্র কমাতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে। কারণ তার ফলে কাজের জায়গায় সহজে পৌঁছে যেতে পেরেছে গ্রামের মানুষ।” কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানায় এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল। পরে মনমোহন জমানায় এই প্রকল্পে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মোদী জমানার পিএম-কিষাণ প্রকল্পের অবশ্য প্রশংসা করেন অভিজিৎ। তিনি বলেন, কৃষকদের সহায়ক মূল্য বাড়ানোর তুলনায় তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা ডাইরেক্ট ট্রান্সফার অনেক বেশি কাজের। তবে যে টাকা কৃষকদের দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়।

প্রসঙ্গত, পিএম কিষাণ প্রকল্পে চাষিদের অ্যাকাউন্টে বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

গ্রামীণ অর্থনীতির মন্দগতি নিয়েও এ দিন উদ্বেগ প্রকাশ করেন অভিজিৎ। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে গ্রামীণ অর্থনীতির বৃদ্ধি বিশেষ হয়নি। প্রচুর অদক্ষ শ্রমিক রিয়েল এস্টেট শিল্পে কাজ করে। কিন্তু রিয়েল এস্টেট শিল্পে যেই মন্দা এসেছে অমনি প্রচুর শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। যা গ্রামের অর্থনীতির বৃদ্ধিকে থমকে দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here