• বিভাস রায়চৌধুরী

কলকাতায় ভাত শিকারে যেতে হয়। ২০০৬-এর সেই ১১ ডিসেম্বর সকালের ট্রেনে উঠেছি। ট্রেন বনগাঁ ছাড়তেই তীর্থদার (কবি তীর্থঙ্কর মৈত্র) ফোন। আকুল কান্নাভেজা গলা—“বিনয়দা নেই। তুই শিগগির আয়।”

কলকাতার সাহিত্য সমাজ বহুদিন আগেই রটিয়ে দিয়েছিল ‘বিনয় পাগল হয়ে গেছে’…সেটা অসুস্থ এক মহাপ্রতিভাকে আলোকোজ্জ্বল কাব্যভুবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমরা প্রতিবেশী হিসেবে দেখেছি— তিনি সরল জীবনযাপন করেন, শিশুকে আদর করেন, অতিথিকে চা খাওয়ান, চাষি-শ্রমিকদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন, গণিতের কৌতূহলী

ছাত্রদের সঙ্গে গণিত নিয়ে আলোচনায় মাতেন। মাঝে মাঝে মানসিক ব্যাধি তাঁকে কাবু করে ফেললে হাসপাতালে ভর্তি হতেন তিনি। সুস্থ হয়ে আবার ফিরতেন শিমুলপুর গ্রামে।
প্রথমে গ্রামবাসীরা তাঁকে বুঝতে না পারলেও পরে ঠাকুরনগরের শিক্ষিত প্রজন্ম ও তাঁর সন্তানপ্রতিম কবি-শিল্পীরা আগলে রাখতেন তাঁকে।

কিন্তু বিনয়ের ছিল নিজের সঙ্গে গভীর সারসের খেলা!

সেখানে পৌঁছনোর যোগ্যতা আমাদের কারো (অগ্রজ-অনুজ) ছিল না। যে নিঃসঙ্গতাকে তিনি লালন করতেন পরম ঘোরে, সেই নিঃসঙ্গতাই তাঁকে সামাজিক সফলতা থেকে দূরে রেখেছে, মাঝে মাঝেই নিয়ে গেছে অসুস্থতা নামক আকাশের সুদূরতায়…

আমরা আবালের মতো পাশ থেকে শুধু দেখেছি—ভাঙা বাড়িতে শুয়ে আছেন বিনয়…
বা পাশের বাড়ি থেকে আসা রাতের ভাত খাচ্ছেন একা একা…
বা আকাশের দিকে আঙুল তুলে বিড়বিড় করছেন…
বা হাসপাতালে নার্সকে লিখে দিচ্ছেন কবিতা…
বা ঘরের ভেতর হেগেমুতে উলটে পড়ে আছেন।

এসব দেখে যন্ত্রণা পাইনি। বরং দুর্মূল্য স্মৃতি সংগ্রহের সুখ পেয়েছি অবচেতনে। সেসব লিখে-টিখেই বিনয়প্রেমীদের কাছে গুরুত্ব কুড়োচ্ছি আজ। কবিকে আমরা এভাবেই গল্পগাছার বস্তু বানিয়ে ফেলি সহজে। কবির চর্চা করি না। বিনয় মজুমদার মানেই একটা অসুখ-অসুখ ব্যাপার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অন্য বিষয়টি। বড় চাকরি ও অন্যান্য উন্নয়ন-রুচি ছেড়ে শুধু কবিতার জন্য‌ই জীবদ্দশা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিনয় এবং এই সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করেননি কোনোদিন। মেনে নিয়েছেন সব দুর্যোগ।

অত‌এব, বিনয় মজুমদার মানেই কবিতা, প্রথম বিবেচনা এটাই। তাঁকে নিয়ে কত কথা হয় ইতিউতি, অথচ এই বাংলায় তাঁর কবিতা নিয়ে কথা কম। বাংলাদেশে অবশ্য বরেণ্য কবি হিসেবে বিনয় চর্চিত ও পূজিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত।

মনে পড়ছে সেই ১১ ডিসেম্বর ২০০৬ ট্রেন থেকে নেমে যাই ঠাকুরনগরে।
বারান্দায় কবির মৃতদেহ।
তখন‌ও লোকজন কম। ধীরে ধীরে মানুষের ঢল নামে। মাতব্বরদের খেলাও চলে।
প্রকৃত দুঃখীকেও ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় নিরালায়।
কী একটা কারণে আমাকে মারতেও আসে একদল।

সেই অপমান আমার গায়ে লাগে না। আমি যে সামনেই দেখছিলাম পৃথিবীর অমর এক কবিতাকে —
“আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে…”

রোগে ‘মুগ্ধ’ ? আকাশের লালা?

১১ ডিসেম্বর ২০০৬ রাতে বমি করে ঘর ভাসাচ্ছি… চেতনা হারাচ্ছি…আর অল্প অল্প টের পাচ্ছি ঈশ্বরের মতো অভিমান ছাড়া আকাশের লালা ঝরা ইহজন্মে দেখতে পাওয়া অসম্ভব…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here