দেশের সময়: বীরভূমের সমৃদ্ধশালী গ্রাম একচক্রা। সাঁইথিয়া আর রামপুরহাটের মাঝামাঝি এর অবস্থান।

কেন বিখ্যাত এই নগর?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তৃতীয়দিনে দুর্যোধনের কটূবাক্যে উত্যক্ত হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে সংহার করতে মন্ত্রপূত বাণ হাতে তুলে নিলেন মহামতি ভীষ্ম। বাণে বাণে তিনি জর্জরিত করে ফেললেন অর্জুনকে। মুমূর্ষুপ্রায় অর্জুনের চলার শক্তি নেই। এ দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পরিত্যক্ত রথের চাকা খুলে নিয়ে মতান্তরে চক্র হাতে ভীষ্মকে আঘাত করতে উদ্যত হলেন তিনি। কিন্তু এই যুদ্ধে অস্ত্র হাতে না তোলার প্রতিজ্ঞা রাখতে শেষমেশ ক্রোধ সংবরণ করলেন কৃষ্ণ। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন রথের চাকা।

জনশ্রুতি, সেই চাকা গড়াতে গড়াতে এসে থামল রাঢ়বঙ্গের গ্রামে। এর থেকেই জায়গাটির নাম একচক্রা। গোটা ভারতে অবশ্য বেশ কয়েকটি প্রাচীন একচক্র গ্রাম রয়েছে। ফলে এনিয়ে রয়ে গিয়েছে বিতর্ক।

পঞ্চপাণ্ডব এবং কুন্তীও বসবাস করেছিলেন একচক্রা গ্রামে।
কেন এলেন তাঁরা এই গ্রামে? এলেনই বা কীভাবে?
সেও এক টানটান কাহিনী।

মহাভারতে বলা হয়েছে, কিছুদিন আগেই হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করেছেন ভীম। তাঁর ক্ষমতা চাক্ষুস করেছেন চার ভাই ও মা কুন্তী। এর পর দুর্যোধন যাতে তাঁদের খোঁজ না পান, সেজন্য পাণ্ডবরা জটা বল্কল মৃগচর্ম ধারণ করে তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে পথে দেখা হল পিতামহ ব্যাসের সঙ্গে। তিনি বললেন, তোমাদের সমস্ত বৃত্তান্ত জানি। বিষন্ন হয়ো না। তোমাদের মঙ্গল হবে। যতদিন না আমার সঙ্গে তোমাদের আবার দেখা হচ্ছে, ততদিন তোমরা এই একচক্রা নগরে সুখে অবস্থান করো। মাস পূর্ণ হলে ফের আমি এসে নিয়ে যাব তোমাদের।


একচক্রায় এক গরিব ব্রাহ্মণের বাড়িতে উঠলেন পাণ্ডবরা। সারাদিন ভিক্ষা করে এনে কুন্তীর হাতে তুলে দেন পাঁচভাই। কুন্তী সেই ভিক্ষা দু’ভাগে ভাগ করেন। একভাগ দিয়ে পেট ভরান চার ভাই ও কুন্তী। বাকি একভাগ ভীমের একার জন্য।
একদিন যুধিষ্ঠির ভিক্ষা করতে গিয়েছেন। ঘরে রয়েছেন শুধু কুন্তী আর ভীম। এমন সময় তাঁদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের কান্না শুনতে পেলেন কুন্তী। এগিয়ে গেলেন তিনি। দেখলেন, ঘরে বসে স্ত্রী ও নাবালক ছেলেমেয়ের সামনে বিলাপ করছেন ব্রাহ্মণ।


কুন্তী বললেন, কী হয়েছে। আমায় বলুন। যদি আমি আপনাদের কোনও সাহায্য করতে পারি।
ব্রাহ্মণ জানালেন, এই নগরের কাছেই রয়েছে অসুরদের কোট (রাজধানী)। সেখানে বাস করে বক নামে এক রাক্ষস। আমাদের রাজা দুর্বল, নির্বোধ। তিনি প্রজাদের রক্ষা করতে অক্ষম। সে কারণে বক রাক্ষসই আমাদের দেশ রক্ষা করে। বিনিময়ে গ্রামের সবাইকে পালা করে প্রতিদিন এক গরুরগাড়ি খাবার আর দু’টি মোষ পাঠাতে হয় তাকে। যেদিন যে খাবার নিয়ে যায় আর ফিরে আসে না। রাক্ষসের পেটে যায়। আজ আমার পালা। কিন্তু রাক্ষসের খাবার জোগাড়ের তো সামর্থ্য নেই আমার। এখন কী করব!


সব শুনে কুন্তী আশ্বস্ত করলেন ব্রাহ্মণকে। বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আজ রাক্ষসদের কাছে খাবার নিয়ে যাবে আমার ভীম।
ব্রাহ্মণ আপত্তি করলেন। বললেন, তা হয় না। আপনারা আমার অতিথি। জেনেশুনে আপনাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।
আমার ভীম বীর্যবান। মন্ত্রসিদ্ধ ও তেজস্বী। ভীমের প্রতি আমার বিশ্বাস অটূট। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বললেন কুন্তী।


এমন সময় ভিক্ষা সেরে ফিরে এলেন যুধিষ্ঠির। সব শুনে মায়ের উপর রেগে গেলেন তিনি। বললেন, এ আপনি মোটেই ঠিক করেননি। যাঁর জন্য আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি, যাঁর ভয়ে দুর্যোধন বিনিদ্র রাত কাটান, যিনি আমাদের জতুগৃহ থেকে উদ্ধার করেছেন, সেই ভীমকে আপনার এভাবে রাক্ষসের মুখে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি।


কুন্তীর উত্তর, তুমি চিন্তা করো না যুধিষ্ঠির। ভীমের বল অযুত হস্তির সমান। তাঁর তুল্য বলবান আর কেউ নেই। আমরা ব্রাহ্মণের গৃহে সুখে, নিরাপদে বাস করছি। তাঁর আজ বিপদ আসন্ন। আমাদের তো তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত।

একচক্রায় বক রাক্ষস বধ নিয়ে কী বলছে পৌরাণিক অভিধান?

ওই গ্রন্থ বলছে, মায়ের কথা মতো রাক্ষসদের কাছে খাবার নিয়ে গেলেন ভীম। তার পর নিজেই সেই খাবার খেয়ে ফেললেন। এ দেখে রাক্ষসরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ করল ভীমের উপর। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হল যুদ্ধ। অবশেষে বক রাক্ষসকে বধ করলেন ভীম। শান্তি স্থাপন হল গ্রামে।

জনশ্রুতি, বক রাক্ষসের হাঁটুর মালাইচাকি খুলে পড়ল পাথরের উপর। একচক্রার কাছে কোটাসুরে সেটিই পাথরে ফসিল হয়ে রয়েছে। যদিও এনিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।
এই একচক্রা গ্রাম আরও একটি কারণে বিখ্যাত। এখানেই আবির্ভাব ঘটেছিল প্রভু নিত্যানন্দের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here