পার্থ সারথি নন্দী: আকাশে তখন সূর্য উঠছে। কাঁসর-ঘণ্টা সহযোগে ঠাকুরদালানে উঠল একচালার প্রতিমা। নাটমন্দিরের সিঁড়ির সামনে বসল ব্যারিকেড। সেই দিকে তাকিয়ে প্রবীণ গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘পঞ্চমীর সন্ধ্যায় বেদিতে ঠাকুর ওঠা বনগাঁর রাখালদাস বন্দ্যোপাধায় বাড়ির দুর্গাপুজোর পরম্পরা। তবে সিঁড়ি বেয়ে দর্শনার্থীদের উঠতে না পারাটা দ্বিতীয় বছর।’’ প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কলকাতা থেকে দেশে আসেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।গতবারের মত এ বারও তাঁদের ভরসা ভিডিয়ো-কল। এ বছর ফুল ছাড়াই হবে অঞ্জলি। দেখুন ভিডিও:

মণ্ডপে প্রবেশ নিষেধ। তবুও প্রতিবেশীদের অনেকেই পুজো দেখতে আসবেন তাঁদের বাড়িতে। আর তাই বাড়িতে ঢোকার মুখেই স্যানিটাইজ়েশন টানেল বসানো হয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। সেই পরিবারের এক সদস্য জানালেন, ‘‘পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই বাড়ি লোকে ভরে যেত। এ বার আত্মীয়েরা তেমন ভাবে আসতে পারেননি। অষ্টমীতে পূণ্যার্থীদের দখলে চলে যায় বাড়ির ঠাকুরদালান ৷ এবাও পড়শিদের নিয়েই পুজোটা কাটিয়েদেব ।’’ এমন কি করোনা সতর্কতার জেরে কোনও ফোটোগ্রাফারকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না এ বছরও৷ প্রায় সময় বন্ধ রাখা হবে মূলপ্রবেশ দ্বার৷ এবছর পাত পেড়ে খাওয়ার বদলে অষ্টমীর ভোগ পৌঁছে দেওয়া হবে বাড়ি বাড়ি। ‘দূরত্ব-বিধি তো মানতেই হবে। গ্রামের মানুষের কথা ভেবে এবছর বিসর্জনে তাই বাড়ির মহিলা ও শিশুরা থাকবেন না’৷

ঐতিহাসিক রাখালদাসের স্মৃতিবিজড়িত ‘বন্দ্যোপাধ্যায়  বাড়ির কিছু গল্প কথা’:

কলকাতা থেকে বনগাঁ লোকাল ট্রেনে চেপে সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন ইছামতী নদী তীরের প্রান্তিক জনপদ বনগাঁয়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বনগাঁ শহর-সংলগ্ন ছয়ঘরিয়া এলাকায় প্রত্নস্তুপের মাঝে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংঘর্ষ করছে প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটো ঠাকুরদা গৌরহরি বন্দ্যোপাধায়ের বাড়ি। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই শহরে জন্মগ্রহণ করেননি বা এখানে বসবাসও করতেন না কিন্তু পারিবারিক দুর্গাপুজোর সময় যেখানেই থাকুন না কেন এখানে চলে আসতেন।

আর সেকারণে আজও এলাকার মানুষজন রাখালদাসকে নিজেদের লোক বলেই মনে করেন।রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটো ঠাকুরদাদার বাড়ি খুঁজতে একটু সময় লাগবে কারণ রাখালদাস কে ছিলেন তা অনেকেই ঠিকমতো জানেন না। এমনিতেই রাখালদাস বাঙালির কাছে ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া এক ঐতিহাসিক! যার কৃতিত্বকে ব্রিটিশরা যেমন চতুরভাবে চেপে দিয়েছিল ঠিক একইভাবে বাঙালিরাও তাকে কেমন যেন অবহেলায় চাপা দিয়ে ফেলেছে। তাঁর লেখা বই সহজে মেলে না, মেলে না তাঁকে নিয়ে খুব একটা লেখাপত্র। হয়ত তাই আজ রাখালদাসকে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার মত আবিষ্কার করতে হচ্ছে, খুঁজতে হচ্ছে।

ছয়ঘরিয়ার কোনো রাস্তার মোড়ে বা অন্য কোথাও রাখালদাসের নাম বা কিছু নির্দেশ করা নেই। ‘রাখালদাসের স্মতিবিজড়িত বাড়ি’ জিজ্ঞেস করে করে আপনাকে খুঁজে খুঁজে পৌঁছতে হবে সেই ঐতিহাসিক বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি ভাড়াটিয়া। তারা কোনো বিষয়েই কেউ কিছু জানেন না, কেউ কিছু বলবেন না। স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানালেন,  বাড়িটি নানান শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। ফলকহীন দরজা পার হলেই বিশাল উঠোন, দালান বাড়ি। প্রায়  তিনশো বছর আগে রাখালদাসের ঠাকুরদা গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঠাকুর দালানে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন স্বপ্নে অদ্ভুত দর্শন এক দেবীমূর্তি দেখতে পান। যে দেবীমূর্তির কিনা দশটি হাতের মধ্যে দু’টি হাত কেবল বড়। বাকি আটটি হাত বেড়ালের মতো ছোটো ছোটো। স্বপ্নাদেশ পাওয়া দেবীর আদলেই নির্মিত হয় মূর্তি। আর তার নাম হয়ে যায় ‘বেড়ালহাতি দুর্গা’। একসময় সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বলির প্রথা চালু ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। পরে  তা বন্ধ হয়ে চিনি-নাড়ু দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা চালু হয়।

রাখালদাস জন্মসূত্রে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের  হলে কি হবে পারিবারিক দুর্গাপুজোর সময় রাখালদাস প্রতিবছর এই বাড়িতে আসতেন। দাদা দিদি ভাই বোনেদের সঙ্গে হৈ হৈ করে কাটাতেন পুজোর দিনগুলি। নিজের হাতে গ্রামবাসীদের বস্ত্রদান করতেন। দরিদ্র ভোজন করাতেন। আশপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো দেখতে আসতেন তাঁদের তদারকি করতেন রাখালদাস।পুজোর দিনগুলিতে প্রতিদিন নিজে হাতে ভক্তদের প্রসাদ বিতরণ করতেন তারপর নিজে খেতেন।
রাখালদাস চিরকালই জমিদারি মেজাজের মানুষ ছিলেন। জমিদারি আদব কায়দা বজায় রাখতে প্রচুর টাকা খরচ করতেন। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন রাখালদাস। পুজোর কটা দিনে তাই তাঁকে ঘিরে সঙ্গীসাথীদের উৎসাহের সীমা থাকত না।

বিজয়া দশমীর দিন রাখালদাসের খুব উৎসাহ ছিল প্রতিমা নিরঞ্জনে। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনে থাকত নানা চমক। যেমন দশমীর দিন সন্ধ্যাতারা ওঠার পরই হত প্রতিমা নিরঞ্জন। রাখালদাস থাকতেন প্রতিমা নিরঞ্জনের দায়িত্বে। স্থানীয় নাওভাঙা নদীতে নিয়ে যাওয়া হত প্রতিমা। দু’টি নৌকোর ওপর প্রতিমা রেখে প্রথমে প্রতিমাকে সাত পাক ঘোরানো হত। তারপর নৌকো দু’টিকে ধীরেধীরে দু’দিকে সরিয়ে দেওয়া হত। প্রতিমা পড়ে যেত জলে। দেবী প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের তালে আকাশ বাতাস জুড়ে আওয়াজ উঠত ‘আসছে বছর আবার হবে।’

পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস যেভাবে ভারতের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্রগুলি ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন ঠিক তেমনি ইছামতী তীরে নিজেদের পারিবারিক এলাকাতেও খোঁজ চালিয়েছিলেন তিনি। রাখালদাসের গুরু ছিলেন পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। গুরু হরপ্রসাদই রাখালদাসের মনমধ্যে পুরাতত্ত্ব্বের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেন।আর গুরুর কথামতো রাখালদাস ঠাকুরদার বাড়ি এলেই তাই খুঁজে বেড়াতেন স্থানীয়  ইতিহাস।

ইছামতী নদীর তীরে প্রান্তিক শহর বনগাঁ।আর এই বনগাঁ শহর পত্তনের বহু আগেই রাখালদাসের পারিবারিক গ্রাম ‘ছয়ঘরিয়ার’ উৎপত্তি। আর নিজের গ্রামের বিষয়ে অনেক অজানা কথা জানিয়েছেন খোদ রাখালদাস নিজে। বাংলার নবাব হুশেন শাহের খুব কাছের মানুষ ছিলেন  রাজা রামচন্দ্র খাঁ। রামচন্দ্র খাঁর জামাতার বংশধর রামবল্লভ মুখোপাধ্যায় মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে একবার সাহায্য করেন আর সেই সূত্রে ইছামতী তীরের এই বিরাট অঞ্চলের জায়গীর লাভ করেন রামবল্লভ। তাঁর ছয় পুত্র সন্তান ছিল।তা থেকেই এই এলাকার নামকরণ হয়ে যায় ‘ছয়ঘরিয়া’।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত  বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার এই বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আসলে হাজারও প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে ঐতিহাসিক রাখালদাস আবিষ্কার করেছিলেন মহেঞ্জদারো, আর আমরাও হাজারও প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে  আবিষ্কার করছি রাখালদাসকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here