দেশের সময় ওয়েব ডেস্কঃ ২০০১ সালে সংসদ ভবনে হামলা। ২০০৬ সালে মুম্বইয়ে ট্রেনে বিস্ফোরণ। ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে একইসঙ্গে অনেকগুলি জায়গায় জঙ্গি হানা। এই তিনটি ঘটনার মূল চক্রান্তকারী একজনই। তিনি হলেন হাফিজ মহম্মদ সইদ। ভারতের কাছে তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্ট। খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম তাঁর।

পরে পাকিস্তানের একনায়ক জিয়াউল হকের নেকনজরে পড়ে হয়ে ওঠেন জঙ্গি নেতা। জামাত উদ দাওয়া নামে এক সংগঠনের শীর্ষ নেতা তিনি। লস্কর ই তইবার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। বুধবার তাঁকে গ্রেফতার করেছে পাকিস্তানের পুলিশ।

১৯৫০ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে এক রক্ষণশীল পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। দেশভাগের আগে তাঁদের পরিবার থাকত সিমলায়। পার্টিশানের সময় লাহৌরে আসতে গিয়ে পরিবারের অনেকে মারা পড়ে।

হাফিজের উন্নতি শুরু হয় জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে। তিনি হাফিজকে সরকার নিয়ন্ত্রিত কাউন্সিল অব ইসলামিক ইডিওলজির সদস্য হিসাবে নিয়োগ করেন। আটের দশকের শুরুর দিকে সেই কাউন্সিল তাঁকে সৌদি আরবে পাঠায়। সেখানে তিনি আফগানিস্তানের মুজাহিদিনের সংস্পর্শে আসেন। জেহাদি মতাদর্শে দীক্ষিত হন।

হাফিজের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে দু’টি এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া কিং সৌদ ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেন।

১৯৮৭ সালে হাফিজ মারকাজ দাওয়া ওয়াল ইরশাদ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। সেই সংগঠনই ন’য়ের দশকের গোড়ায় লস্কর ই তইবার জন্ম দেয়। ২০০১ সালে ভারতের সংসদ ভবনে হামলার পরে পাকিস্তানে হাফিজকে আটক করা হয়। ২০০২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। পরে ১৫ মে তাঁকে ফের গ্রেফতার করা হয়। তাঁর স্ত্রী মাইমুনা বেগম পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের ফেডারেল গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাঁর অভিযোগ, হাফিজকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয়েছে। ২০০২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে তাঁকে গৃহবন্দি রাখা হয়।

২০০৬ সালের ১১ জুলাই মুম্বইয়ে ট্রেনে বিস্ফোরণ হয়। পাঞ্জাব পুলিশ তাঁকে ৯ অগাস্ট গ্রেফতার করে। তিনি গৃহবন্দি হয়ে থাকেন। হাইকোর্টের নির্দেশে ২৮ অগাস্ট তিনি ছাড়া পান।

২০০৮ সালে মুম্বই হামলার পরে ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘে অনুরোধ করে হাফিজ ও জামাত উদ দাওয়াকে লস্করের ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হোক।

২০০৯ সালের ২৫ অগাস্ট ইন্টারপোল হাফিজের বিরুদ্ধে রেড কর্নার নোটিস জারি করে। সেবছরের অগাস্টে লাহোর হাইকোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে দেয়।

২০০২ সালের এপ্রিলে আমেরিকা সইদের মাথার দাম ঘোষণা করে এক কোটি ডলার।

২০১৬ সালে হাফিজ ও জামাত উদ দাওয়াকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করা হয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে হুমকি দেন, তাদের নাগরিকদের অভিবাসনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। কারণ পাকিস্তানের নাগরিকরা আমেরিকার পক্ষে বিপজ্জনক। তার একদিন বাদে হাফিজকে গৃহবন্দি করা হয়।

২০১৯ সালের জুন মাসে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সন্ত্রাসবাদীদের অর্থের যোগান বন্ধ করার জন্য তারা যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি।

২৬/‌১১ জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড হাফিজ সইদকে গ্রেপ্তার করল পাকিস্তান পুলিশ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত কোণঠাসা হওয়ার ফলে এই গ্রেপ্তার বলে মনে করা হচ্ছে। জামাত–উদ–দাওয়ার প্রধানের গ্রেপ্তারিতে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক খবর। পাকিস্তান পুলিশের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা দপ্তর বুধবার হাফিজ সইদকে গ্রেপ্তার করেছে বলে খবর।

এদিন লাহোর থেকে গুজরানওয়ালা যাওয়ার পথেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। তাকে বিচারবিভাগীয় হেপাজতে নেওয়া হবে বলে সূত্রের খবর। যদিও হাফিজের দাবি, সবরকম মামলার চ্যালেঞ্জ করা হবে আদালতে। পাকিস্তান বিশ্বের দরবারে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ক্রমাগত সমালোচিত হচ্ছিল। তার ওপর ইমরান খান সরকার এখন প্রবল অর্থকষ্টে ভুগছে।

সেখানে বিদেশের সাহায্য তাঁদের দরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ তাদের মাটি থেকে উপড়ে না ফেললে কোনও সাহায্য করা হবে না। উলটে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।
এই সাঁড়াশি চাপের কাছে নত হয়েই হাফিজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া এটাও প্রমাণিত হয়ে গেল হাফিজ সইদ পাকিস্তানেই বহাল তবিয়তেই ছিল। সেখান থেকেই সে মুম্বই হামলার ছক কষেছিল। এবং হামলা করেছিল।

দু’দিন আগেই পাকিস্তান তাদের আকাশসীমা ভারতের জন্য খুলে দিয়েছিল। ফলে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছে। সেটাও করা হয়েছিল নিজেদের ভাবমূর্তির স্বার্থে।

এবার হাফিজ সইদকে গ্রেপ্তার করে আরও মুখরক্ষা করার চেষ্টা করা হল বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানেই হাফিজের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা ছিল। তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে জামিনও পেয়েছিল সে। হাফিজ সইদকে ইতিমধ্যেই বিশ্বের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে চিহ্নিত করেছে আমেরিকা। আর এই গ্রেপ্তারির পর আমেরিকার কাছে ভাল সাজতে পারবে পাকিস্তান বলেও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here