দেশের সময় ওয়েব ডেস্কঃ পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না। ছোটবেলা থেকেই গোটা গ্রামটা দাপিয়ে বেড়াত ডানপিটে তিয়াসা। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে, শনশন করে তার সাইকেল ছুটত গ্রামের আনাচ কানাচে। মা-বাবার নজর এড়িয়ে একদিন সাইকেলের চাকা ছুটল রাজ্য সড়ক ধরে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে তিয়াসা পৌঁছল গ্রাম থেকে শহরে। ধীরে ধীরে জেলা ছাড়িয়ে রাজধানী, রাজ্য থেকে জাতীয় স্তর পেরিয়ে আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে নাম লিখিয়ে ফেলল নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের তিয়াসা পাল।
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান সাইক্লিং চ্যাম্পিয়নশিপের জোড়া পদক এখন তিয়াসার ঝুলিতে। চলতি বছর জানুয়ারিতে জাকার্তার ওই ইভেন্টে সাব জুনিয়র বিভাগে যোগ দেয় তিয়াসা। সেখানে টাইম ট্রাভেলে ব্রোঞ্জ ও টিম স্প্রিন্টে রূপো জিতে নেয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরেই রাজস্থানে ন্যাশনাল সাইক্লিং চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেয় সে। জাতীয় স্তরেও জেতে জোড়া পদক। ‘‘আমার পরবর্তী লক্ষ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে,’’ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে সাফল্যের পর তিয়াসার চোখে এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন।
সাইকেল চালাতে বরাবরই খুব ভালোবাসত। মেয়ের বয়স যখন ১০ বছর, সকলের নজরে পড়ে ওর এই ট্যালেন্ট, সেই থেকে শুরু,’’ তিয়াসার মা চন্দনা পালের মুখে গর্বের হাসি। জানালেন, স্কুল থেকে ফিরেই বাড়ির সামনে চাকদহ থেকে কল্যাণী যাওয়ার রাস্তা ধরে সাইকেল ছোটাত তিয়াসা। কারও বারণ শুনতো না। ছুটির দিনেও সাইকেল নিয়ে চষে বেড়াত আশপাশের কয়েকটা গ্রাম। সাইকেলের প্রতি তার এই টান প্রথম লক্ষ্য করেন স্থানীয় ক্লাবের কোচ জিবেশ ঘোষ। তিনিই হাতে ধরে তিয়াসাকে সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। রাজ্য স্তরের কয়েকটা ইভেন্টে সাফল্য আসার পরই দিল্লি পাড়ি দেয় তিয়াসা। সাহায্য করেন কোচ জিবেশবাবুই। তিয়াসার মায়ের কথায়, অভাবের সংসারে ঠিকমতো প্রস্তুতির সময় বার করাটা যেমন ছিল কঠিন, তেমনি দুষ্কর ছিল জাতীয় স্তরে প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিশাল খরচ বহন করা। তবে সবসময়েই পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাহায্য করেছেন স্থানীয় ক্লাবের সদস্যেরা।
রাজধানী পৌঁছে তিয়াসার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। দিল্লির সাই ক্যাম্পে তার ট্যালেন্ট মনে ধরে কোচদের। শুরু হয় প্রশিক্ষণ। ৮-১০ জানুয়ারি এশিয়ান সাইক্লিং চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ছ’জন। তার মধ্যে ছিল নদিয়ার তিয়াসাও। জোড়া পদক ঝুলিতে পুরে নেয় সে। জানুয়ারিরই মাঝামাঝি রাজস্থানে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলার পাঁচ জনকে পিছনে ফেলে সোনা জিতে নেয় তিয়াসা।
ছোট থেকেই সাইকেল চালাতে ভালোবাসতাম। তা ছাড়া, অন্যান্য খেলার মধ্যে সাইকেলের খরচ অনেক কম। তাই এই খেলাকেই বেছে নিয়েছি। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য বড় মাপের প্রস্তুতি দরকার। রাজ্য সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করছি,’’ হারতে রাজি নয় তিয়াসা। বিশ্বজয় তাকে করতেই হবে।
চাকদহ মদনপুর এক নম্বর পঞ্চায়েতের গোবিন্দনগর এলাকায় একটেরে ছোট্ট বাড়ি তিয়াসাদের। একটাই ঘর। তাতে কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকেন পাঁচ জন। বাবা ত্রিদিব পালের ছোটখাটো জলের ব্যবসা। ছেলেরাও তাই করেন। অভাবের সংসার। চাকদহ শিমুরালি উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তিয়াসা খেলাধূলার পাশাপাশি চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে চায় ৷