দেশের রান্নাঘর: সিঙ্গাড়া রে সিঙ্গাড়া তোর যে দুটোশিং খাড়া:

0
522
সিঙ্গাড়া রে সিঙ্গাড়া তোর যে দুটোশিং খাড়া’

ছোটবেলার এই ছড়াটা খুব আবছা ভাবে মনে পড়লেও আমাদের সকলেরই প্রায় জানা| সিঙ্গাড়ার এই ছড়া আমাদের স্মৃতিতে আবছা হয়ে এলেও ভোজনবিলাসী বাঙালির জীবনে সিঙ্গাড়ার অস্তিত্ব আজও বেশ উজ্জ্বল ; ক্যালেন্ডারের পাতা যখন ডিসেম্বরের ঘরে, তখন শীতের বিকেলের জলখাবারের প্লেটে গরম ধোঁয়া ওঠা সিঙ্গাড়ার একটা কামড় আর তার ভিতর থেকে যদি বেরিয়ে আসে ভাজা জিরে মশলার গন্ধে মাখা ফুলকপি আর কড়াইশুঁটির যুগলবন্দী তা যে কোনো টেক স্যাভি ম্যাগি কিংবা পিজা পাস্তার অনুরাগীকেও সহজেই কাবু করে ফেলবে; ক্যালোরির ইতি টেনে দু-এক কামড়েই অনায়াসেই প্লেট সাফা করে ফেলবে যে কেউ| তবে বাঙালির এমন মনের মতো প্রিয় সুস্বাদু এই খাবারটি শুধু যে কলকাতারই গর্ব তা নয় সমগ্র ভূ-ভারতেই এর জুড়ি মেলা ভার| কলকাতার বাইরে এর পরিচিতি সামোসা নামে | সামোসা শব্দের উদ্ভব পার্সিয়ান শব্দ সানবসাগ থেকে | এর এই তিন কোনা আকৃতির জন্যই কোথাও এর নাম সানবুসাক অথবা সানবুসাজ, মূলত: আরব শহরগুলিতে| তবে এর মূল উৎসস্থল মধ্য এশিয়াই | ঐতিহাসিক আবুল ফজল, কবি আমির খুসরুর লেখাতে সামোসা অথবা আমাদের সিঙ্গাড়ার উল্লেখ রয়েছে, ত্বৎকালীন রাজাদের জন্য কিভাবে ঘি, পিয়াঁজ ও মাংস দিয়ে এটি তৈরী হতো | আবার মুঘল আমলের আইনি – আকবরীতেও মধ্য এশিয়ার একপ্রকার জলখাবার হিসেবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়| স্থান বিশেষে ভারতবর্ষেরই বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বিভিন্ন ভাবে এই সাম্বুসাজ অথবা সামোসা তৈরী করে থাকে| কোথাও এর আকৃতি ত্রিকোণাকার আবার কোথাও অর্ধচন্দ্রাকার; শুধু আকৃতিই নয় প্রস্তুতির ধরনও ভিন্ন | পাঞ্জাব, দিল্লি, হিমাচল তথা সমগ্র উত্তর ভারতে সামোসা মূলত তৈরী হয় বিভিন্ন মশলা, আলু, মটর, কাঁচালঙ্কা দিয়ে; আবার কোথাও কোথাও কাজু কিশমিশও এর সঙ্গে মেশানো হয়ে হয়ে থাকে | ময়দার খোল তৈরী করে ডুব তেলে ভেজে তেঁতুল, ধনেপাতা পুদিনা পাতার চাটনির সাথে পরিবেশন করা হয় | আবার পূর্ব ভারতের কলকাতা, ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে একে বলা হয় সিঙ্গাড়া| এখানে কোথাও কোথাও সিঙ্গাড়া তৈরী হয় আলু মশলা ছাড়াও মাছ কিংবা মাংস দিয়েও| সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে স্থান বিশেষে সিঙ্গাড়ার পুরও ভিন্ন হয়| এতো গেলো সিঙ্গাড়ার পরিচিতি আর জন্মবৃত্যন্ত কিন্তু তা দিয়ে তো আর ভোজনবিলাস পূর্ণ হয় না! এমন একটি উপাদেয় খাদ্যতে দুএক কামড় না বসালে রসনা তৃপ্ত হবে কেমন করে; তাই এবারের দেশের রান্নাঘরের মেনুতে রইলো সেই সিঙ্গাড়া অথবা সামোসার কিছু রেসিপি |

আলু ফুলকপি কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়া – (0 টি )

উপকরণ: ময়দা ২৫০ গ্রাম, নুন ৫ গ্রাম, চিনি ১২ গ্রাম, ময়ানের জন্য ঘি ৩৫ গ্রাম, জল ৮৫ গ্রাম, আলু ৫০০ গ্রাম, একটা মাঝারি সাইজের ফুলকপি ১২৫ গ্রাম, ৫-৬ টা কাঁচালঙ্কা, আদা ১৮ গ্রাম, চিনাবাদাম ৩০ গ্রাম, কড়াইশুঁটি ৩০ গ্রাম, পাঁচফোড়ন ৩/৪ চা চামচ, শুকনোলঙ্কা ২ টো, চিনি ৬ গ্রাম, নুন ৬ গ্রাম, বীটনুন ৪ গ্রাম, কস্তুরী মেথি ১/২ চা চামচ, জিরে গুঁড়ো ৪ গ্রাম, ধনে গুঁড়ো ৫ গ্রাম, হলুদ ৪ গ্রাম, লালঙ্কাগুঁড়ো ৩ গ্রাম, আমচুর পাউডার ২ গ্রাম, গরম মশলা ২ গ্রাম, চাট মশলা ৬ গ্রাম, ভাজার জন্য তেল ৩০০ গ্রাম |
প্রণালী: ময়দা ময়ান দিয়ে মেখে চাপা দিয়ে রেখে দিতে হবে| আলু খোসা না ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে| ফুলকপি ছোট ছোট টুকরো করে নিতে হবে| কড়াইতে দুচামচ তেল দিয়ে চিনাবাদাম ভেজে তুলে নিতে হবে| এরপর ফুলকপিও হালকা ভেজে তুলে নিতে হবে যেন বেশি সিদ্ধ হয়ে গুড়িয়ে না যায়| সবরকম গুঁড়ো মশলা একসাথে মিশিয়ে রাখতে হবে| আদা ও কাঁচালঙ্কা একসাথে বেটে নিতে হবে| কড়াইতে আবার দু বড় চামচ তেল দিয়ে শুকনোলঙ্কা ও পাঁচফোড়ন দিতে হবে| এরপর কুচানো আলু, কড়াইশুঁটি, আদা কাঁচা লঙ্কা বাটা, নুন, চিনি, মেশানো গুঁড়ো মশলা ৮ গ্রাম দিয়ে ভালো করে নেড়ে জল দিতে হবে এরপর চাপা দিয়ে ভাজতে হবে| জল শুকিয়ে আলু নরম হয়ে এলে বাদাম ও ফুলকপি ভাজা,কস্তুরী মেথি ছড়িয়ে মিশিয়ে দিতে হবে| আলুর পুর নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে | ময়দার ৭ গ্রাম ওজনের লেচি কেটে ডিম্বাকৃতিতে বেলে অর্ধেক করে অর্ধচন্দ্রাকারে কেটে নিতে হবে| এরপর সিঙ্গাড়ার আকারে গড়ে পুর ভরতে হবে| সব কোটায় পুর ভরা হয়ে গেলে করে তেল বসিয়ে হালকা আঁচে সিঙ্গাড়া ভেজে নিতে হবে|
কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়া

উপকরণ: কড়াইশুঁটি এক কেজি, ময়দা ২৫০ গ্রাম, ময়ানের জন্য ঘি ৩৫ গ্রাম, জল দেড় কাপ, ৫-৬ টা কাঁচালঙ্কা, আদাবাটা ১ চামচ, ভাজা জিরে গুঁড়ো দেড় চামচ, ধনে গুঁড়ো ১ চা চামচ, ছাতু ৫০ গ্রাম, জোয়ান ১ চা চামচ, কালো জিরে ১ চা চামচ, নুন ২ চামচ, চিনি ১ চামচ, ভাজার জন্য তেল ৩০০ গ্রাম |
প্রণালী: ময়দায় ঘি, নুন, কালোজিরে দিয়ে ময়ান দিতে হবে এরপর জল দিয়ে ভালো করে মেখে চাপা দিয়ে একঘন্টা রাখতে হবে| কড়াইশুঁটি ছাড়িয়ে মিক্সিতে কাঁচালঙ্কা দিয়ে বেটে নিতে হবে| কড়াইতে ৩ চামচ তেল দিয়ে কড়াইশুঁটির পুর ঢালতে হবে, এরমধ্যে আদা বাটা, নুন, ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, ছাতু, জোয়ান হাতে গুঁড়িয়ে নিয়ে দিতে হবে; সবকিছু ভালো ভাবে মিশিয়ে কড়াইশুঁটির জল যতক্ষণ না পুরো শুকিয়ে আসে ততক্ষন নেড়ে যেতে হবে| কড়াইশুঁটির পুর সম্পূর্ণ শুকনো হয়ে এলে এরমধ্যে চিনি দিয়ে আরেকবার ভালো ভাবে মিশিয়ে নামিয়ে নিতে হবে|
ময়দা থেকে লেচি কেটে নিতে হবে| একেকটি ময়দার লেচিকে ডিম্বাকৃতিতে বেলে মাঝখান থেকে দুভাগ করে কেটে দিতে হবে এবার কাটা টুকরোর চারপাশে জল লাগিয়ে ময়দার অর্ধচন্দ্রাকার টুকরোটিকে কোণের মতো মুড়ে দিতে হবে এর ফাঁকা অংশে কড়াইশুঁটির পুর ভরে সিঙ্গাড়ার আকৃতিতে গড়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে| এইভাবে সবকটি লেচি দিয়ে সিঙ্গাড়া বানিয়ে নিতে হবে| কড়াইতে তেল একদম হালকা গরম করে ডুবো তেলে সিঙ্গাড়া ভেজে নিতে হবে| ধনেপাতা ও পুদিনার চাটনির সাথে পরিবেশন করা যেতে পারে|
মাংসের সিঙ্গাড়া

উপকরণ: ময়দা ২৫০ গ্রাম, ৩ চা চামচ নুন, তেল বা ঘি ৩ চামচ, ১/২ চা চামচ কালোজিরে, দেড় কাপ জল, তেজপাতা ১ টা, ছোট এলাচ ২ টো, মাঝারি সাইজের দারচিনি ২টো, লবঙ্গ ৪টি, কুচানো পিয়াঁজ ১ কাপ, আদা বাটা ১ চামচ, রসুন বাটা ১ চামচ, ১ চা চামচ ধনেগুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, গরমমশলার গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, ১ চা চামচ লঙ্কাগুঁড়ো, ১/২ চা চামচ হলুদগুঁড়ো, পাঁঠার মাংসের কিমা ৩০০ গ্রাম, কাঁচালঙ্কা ৩-৪ টি, ভাজার জন্য তেল ৩০০ গ্রাম |

প্রণালী: একটা পাত্রে ময়দা, ১ চা চামচ নুন, ৩ চামচ তেল অথবা ঘি ও কালোজিরে দিয়ে ভালো করে ময়ান দিতে হবে| এরপর সোয়া এক কাপ ঠান্ডা জল দিয়ে ময়দা মেখে চাপা দিয়ে একঘন্টা রেখে দিতে হবে| কড়াইতে ৩ চামচ তেল অথবা ঘি গরম করে তেজপাতা ও গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিতে হবে| এরপর পিয়াঁজ হালকা ভেজে, আদা রসুনবাটা ও কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে একটু কষে নিয়ে তারমধ্যে কিমা, ২ চামচ নুন ও সবরকম গুঁড়োমশলা দিয়ে চাপা দিয়ে ভালো করে কষতে হবে | কিমার জল শুকিয়ে এলে ২ চামচ জল দিয়ে যতক্ষণ মাংস নরম হয় কষতে হবে| তেল ছাড়তে শুরু করলে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে | এরপর ময়দা থেকে ৮ টি লেচি কেটে নিতে হবে| একেকটি ময়দার লেচিকে ডিম্বাকৃতিতে বেলে মাঝখান থেকে দুভাগ করে কেটে দিতে হবে এবার কাটা টুকরোর চারপাশে জল লাগিয়ে ময়দার অর্ধচন্দ্রাকার টুকরোটিকে কোণের মতো মুড়ে দিতে হবে এর ফাঁকা অংশে মাংসের পুর ভরে সিঙ্গাড়ার আকৃতিতে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে| এইভাবে সবকটি লেচি দিয়ে সিঙ্গাড়া বানিয়ে নিতে হবে| কড়াইতে তেল একদম হালকা গরম করে ডুবো তেলে সিঙ্গাড়া ভেজে নিতে হবে| টমেটো সস ও শশা পিয়াঁজের স্যালাডের সাথে পরিবেশন করতে হবে|
মাছের সিঙ্গাড়া

উপকরণ: একশো থেকে দেড়শো গ্রাম ওজনের বড় রুই মাছের পেটি ৪-৫ টা, ঘি ৫০ গ্রাম, ময়দা ২৫০ গ্রাম, ৩ চা চামচ নুন, তেল বা ঘি ৩ চা চামচ, দেড় কাপ জল, তেজপাতা ১ টা, ছোট এলাচ ২ টো, মাঝারি সাইজের দারচিনি ২টো, লবঙ্গ ৪টি, কুচানো পিয়াঁজ ১ কাপ, আদা বাটা ১ চামচ, রসুন বাটা ১ চামচ, ১ চা চামচ ধনেগুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, গরমমশলার গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, ১ চা চামচ লঙ্কাগুঁড়ো, ১/২ চা চামচ হলুদগুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা ৩-৪ টি |
প্রণালী : ময়দা ময়ান দিয়ে মেখে এক ঘন্টা চাপা দিয়ে রাখতে হবে| মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিতে হবে| ভাজা মাছ ঠান্ডা হলে কাঁটা বেছে নিতে হবে| এরপর কড়াইতে ঘি গরম করে গোটা গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে পিয়াঁজ ভেজে নিতে হবে; পিয়াঁজ নরম হয়ে এলে আদা রসুন বাটা, মাছ, নুন ও সব গুঁড়ো মশলা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দু এক মিনিট কষতে হবে| বেশ ভাজা ভাজা হলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে দিতে হবে| এরপর ময়দা থেকে লেচি কেটে নিতে হবে| একেকটি ময়দার লেচিকে ডিম্বাকৃতিতে বেলে মাঝখান থেকে দুভাগ করে কেটে দিতে হবে এবার কাটা টুকরোর চারপাশে জল লাগিয়ে ময়দার অর্ধচন্দ্রাকার টুকরোটিকে কোণের মতো মুড়ে দিতে হবে এর ফাঁকা অংশে মাছের পুর ভরে সিঙ্গাড়ার আকৃতিতে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে| এইভাবে সবকটি লেচি দিয়ে সিঙ্গাড়া বানিয়ে নিতে হবে| কড়াইতে তেল একদম হালকা গরম করে ডুবো তেলে সিঙ্গাড়া ভেজে নিতে হবে| টমেটো সস ও শশা পিয়াঁজের স্যালাডের সাথে পরিবেশন করতে হবে|

Previous articleফসল বাঁচাতে কুকুরকে বাঘ সাজালেন কৃষক
Next articleসম্পাদকীয়ঃ বেনাগরিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here