দেশের সময় ওয়েবডেস্ক: দীর্ঘদেহী, সবসময় সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি, আর দেখলেই রাশভারি কণ্ঠে ভালবেসে দুটো কথা, ব্যক্তিগত জীবনে এমনই ছিলেন তিনি। ভারত সরকারের পদ্মপুরস্কার, বাংলার বঙ্গবিভূষণ, এমনই নানা পুরস্কার পেয়েছেন। সেই বাংলা সঙ্গীত জগতের মহিরূপ দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। সোমবার দুপুর বেলা পৌনে দুটো নাগাদ প্রয়াত হলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বাংলা সংস্কৃতির জগতে নেমে এল শোকের ছায়া। উইকিপিডিয়ায় লেখা রয়েছে, এখনও পর্যন্ত দেড় হাজার গান গেয়েছেন তিনি। তিনি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়৷

১৯২৭ সালে পরাধীন ভারতের কটকে ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন দ্বিজেন মুখার্জি। ১৯৪৪ সালে পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন দ্বিজেন। পরের বছর মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির তরফে তাঁর প্রথম বেসিক রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি আকাশবানীর শিল্পী হিসাবেও গান গাইতে শুরু করেন। মূলত রবীন্দ্রনাথের গানে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁকে শিল্পী থেকে সাধকের স্তরে উন্নিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের গানে তার জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন আধুনিক গান কিম্বা প্লেব্যাকেও।

বলা হয়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর। সেই সূত্র ধরেই মুম্বইয়ে একাধিক ছবির প্লেব্যাক করেছিলেন দ্বিজেন। তাঁর গাওয়া ‘‌শ্যামলও বরণী ওগো কন্যা’‌, ‘‌পল্লবীননি গো সঞ্চারীনি’‌ বাঙালির মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায় মহালয়ার প্রভাতি অনুষ্ঠানে তাঁর কণ্ঠে জাগো দুর্গা, এখনও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের শুভ সূচনা করে।

এছাড়াও একাধিক বাংলা ছবিতে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। তপন সিনহার ছবি ক্ষুধিত পাষান, ১৯৭৭ সালে ওস্তাদ আলি আকবর খান ও রবিশঙ্করের সঙ্গীত পরিচলায় সান্ধ্য রাগ, ১৯৭৩ সালের বনপলাশির পদাবলী, ১৯৯৪ সালের হুইল চেয়ার ছবিতেও তিনি গান করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, জাতীয় স্তরে একাধিক সরকারি অনুষ্ঠান ও বিদেশ সফরে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। গান করেছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর সামনে। লাদাখে ভারতীয় সৈন্যদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করারও কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ভারত থেকে শিল্পীদের যে বিশেষ দল অবিভক্ত সোভিয়েত সহ পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশ সফর করেছিল, সেখানেও ছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

শিক্ষক হিসাবেও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ছিলেন অসাধারণ। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাঁর নির্দেশনায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের আদর্শ শিক্ষা লাভ করেছিল। নিজে হাতে কলকাতায় তৈরি করেছিলেন উত্তরায়নী। ছিলেন বিশ্বভারতীর সঙ্গীত বিভাগের বিশেষ শিক্ষক। সন্মানও পেয়েছিলেন অসংখ্য। ২০১০ সালে একদিকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। এই বছরই তিনি পান পদ্মভূষণ। ২০১১ সালে তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে, শেষ কয়েকদিন ধরে শরীর খারাপ ছিল তাঁর। চিকিৎসাও চলছিল। বার্ধ্যক্য জনিত রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন তিনি। সোমবার দুপুর পৌনে দুটো নাগাদ সল্টলেকের এইচ এ ব্লকে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত লড়তে পারলেন না এই দীর্ঘদেহী সুপুরষ সঙ্গীত শিল্পী। বাংলা সঙ্গীত জগতের এক বিরাট স্থান শূন্য করে বিদায় নিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। দ্বিজেন মুখার্জির প্র‌য়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‌দ্বিজেনদার চলে যাওয়া একটি অধ্যায়ের অবসান হল। তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতের একজন মহীরুহ ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সব সরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন তিনি। রবীন্দ্র জগতের রাবিন্দ্রিক শিল্পী ছিলেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here