ঘুম ভাঙতেই দেখি রাস্তার পাশে পদ্মবিল। ফুল ফুটে রয়েছে। পাতা ভেসে রয়েছে। আকাশ গুলে গেছে। জলে। আমি একটু ঝুঁকে, মুখ বাড়িয়ে দেখতে গেলাম। দেখি নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে জলে। কিন্তু আস্তে আস্তে সে মুখ জলে গুলে যাচ্ছে। বিসর্জনের পরে যেমন মাটির প্রতিমা গুলে যায়। গলে যায়। আমি ঝট করে নিজের ছায়া সরিয়ে নিলাম।
ঘুম কাটার আগেই এরকম গলে গিয়ে জলে গুলে গিয়ে লাভ নেই। আমি একটু নেমে জলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাঁটুমুড়ে বসে এক আঁজলা জল নিলাম। পদ্মফোটা জল। ঝাপটা মারলাম মুখে। মুখভর্তি ময়লা ধোয়ার জন্য আঙুল ডলে ডলে ঘসতে লাগলাম। ফেসওয়াশ মাখার মত করে। দেখি প্রচুর রং বেরোচ্ছে মুখ থেকে। আমি আবার আঁজলা ভরে জল নিয়ে ঝপাস্ করে মুখে মারলাম। জোরে। যেন ওটা অন্য কারও মুখ। আবার ঘসতে লাগলাম আঙুল দিয়ে। চেপে চেপে। এবারও প্রচুর রং বের হল। অন্য রং। আগে কখনও দেখিনি এমন রং।
এইভাবে এক একবার এক আঁজলা জলে নিজেকে ধুয়ে ফেলে যখন জলে ডুবে থাকা প্রতিবিম্বের দিকে চাই, দেখি অন্য মুখ। আবার ধুয়ে ফেলি যত্নে মুখমন্ডল। নতুন রং বের হয় মুখ থেকে। জলের গভীরে তখন আবারও অন্য মানুষের মুখ ভাসছে। উপরের জল হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপে। আমারও ভিতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। কত রং মেখেছি আজন্মকাল ধরে! কত পরতের পরে পরত। সবই নতুন নতুন রং। এক একটা করে লেয়ার ধুয়ে ফেলি, এক একটা করে অন্য মানুষ বেরিয়ে আসে। একটাও আমি না। কিন্তু সব মুখই আমার।
এইরকম চলতে চলতে দিন শেষ হয়ে আসে। আলো কমে আসে। কত মানুষ আমার মুখ থেকে নেমে জলে গুলে যায়। কত পুরুষ আমার মুখের আদল নিয়ে পদ্মবনের তলায় সাঁতার কাটে। কত যুবক আমার মধ্যে থেকে বেরিয়ে নীলপদ্ম খুঁজতে লেকে নেমে যায়। এদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনা। আমি শুধু অন্ধকারের খোঁজে পাড়ে বসে থাকি। নিকষ অন্ধকারে আমার মুখটা কোনও কোনও দিন হিংস্র হয়ে ওঠে। ক্রুর হয়ে যায়। সেই মুখটাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য, জলে গুলে দেবার জন্য আমি আলোমুখ করে অন্ধকারের খোঁজ করতে করতে দিন শেষ করে দিই।
সন্ধ্যে হলে একটা গোটা চাঁদ ওঠে আকাশজুড়ে।