দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃনয়া করোনাভাইরাসের গঠন ঠিক কেমন সেই নিয়ে এতদিন বিজ্ঞানী মহলে নানা গবেষণা চলছিল। প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন সিঙ্গল স্ট্র্যান্ডেড এই আরএনএ ভাইরাসের সাতটি স্ট্রেন রয়েছে। তবে এই ভাইরাসের জিনোমের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ গবেষণার স্তরেই ছিল। সেই পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল ভারত। প্রথমবার নয়া করোনাভাইরাস অর্থাৎ সার্স-কভ-২ ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোমের বিশ্লেষণ করলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। গুজরাটের বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার (GBRC)-এ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে।
গুজরাট সরকারের উদ্যোগে জিবিআরসি-তে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জিনের গঠন নিয়ে গবেষণা চলছিল। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই আরএনএ ভাইরাল স্ট্রেনের জিনোমের পূর্ণাঙ্গ সিকুয়েন্স করা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু এই ভাইরাসের মধ্যে বহুবার মিউটেশন হয়েছে, অর্থাৎ ভাইরাস তার জিনের গঠন বদলেছে, তাই এর জিনোম সিকুয়েন্স করা বেশ জটিল ব্যাপারই ছিল। তার উপর বিটা-করোনাভাইরাসের পরিবারের সদস্য হলেও এই ভাইরাস অনেকটাই আলাদা। সার্স ভাইরাসের জিনের সঙ্গে মিল থাকলেও মিউটেশনের ফলে এর গঠন বদলে গিয়েছিল। তাই পূর্ণাঙ্গ জিনের গঠন বার করা একপ্রকার চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজ্ঞানীদের কাছে।
Gujarat is proud of scientists at Gujarat Biotechnology Research Centre (GBRC), the only State Govt laboratory in India that has reported COVID19 whole genome sequence which will be helpful in tracking origin, drug targets, vaccine & association with virulence.#IndiaFightsCorona
— CMO Gujarat (@CMOGuj) April 15, 2020
গুজরাট সরকারের অধীনস্থ জিবিআরসি ল্যাবে সেই জটিল কাজটাই করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্সিং মানে জিনের গঠন চিহ্নিত করা। কীভাবে জিনের বিন্যাস হয়েছে সেটা নির্দিষ্ট করে দেখা। জিবিআরসি-র তরফে জানানো হয়েছে, মারণ ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করার ফলে এবার তার চরিত্র ভালভাবে বোঝা যাবে। এই ভাইরাসের আক্রমণের পদ্ধতি, কীভাবে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে, দেহকোষের বাহক প্রোটিনের সঙ্গে কীভাবে জোট বেঁধে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে তার সবটাই চলে আসবে বিজ্ঞানীদের নাগালে। যার কারণে এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার মতো ড্রাগ বা ভ্যাকসিন তৈরির কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সার্স-কভ-২ কে ঠেকাতে কী ধরনের অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরে দরকার সেটাও বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। ফলে সংক্রমণকে রুখে দেওয়া যাবে গোড়াতেই।
করোনাভাইরাস আসলে নতুন করে জন্ম নেওয়া কোনও ভাইরাস নয়। আগেও ছিল। এই করোনার (CoV)পরিবার অনেক বড়। বিজ্ঞানের ভাষায় এদের পরিবারের নাম ‘করোনাভিরিডি’ (Coronaviridae) । এদের চারটে ভাগ— আলফাকরোনাভাইরাস (alphaCoV), বিটাকরোনাভাইরাস (betaCoV), ডেল্টাকরোনাভাইরাস (deltaCoV) এবং গামাকরোনাভাইরাস (gammaCoV) । আলফাকরোনা ও বিটাকরোনার জিন পাওয়া গিয়েছিল বাদুর ও ইঁদুরের মধ্যে। প্যাঙ্গোলিনের মধ্যেও বিটাকরোনার কিছু জিন পাওয়া গেছে। তাছাড়া উট, গবাদি পশুর মধ্যেও সময় সময় এই ভাইরাস পরিবারের সদস্যদের খোঁজ মিলেছে। আর বাকি দুই পরিবার গামাকরোনা ও ডেল্টাকরোনারা মূলত থাকে পাখিদের মধ্যে (Avian Species) । বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বিটাকরোনাভাইরাস হচ্ছে যত সর্বনাশের মূল। তাদের জেনাস আবার পাঁচটা সাব-জেনাসে বিভক্ত। যাদের স্ট্রেনগুলো লাগামছাড়া। এরা সকলেই মানুষকে আক্রমণ করতে ভালবাসে। কেউ মামুলি সর্দি-জ্বরেই সীমাবদ্ধ থাকে, আবার কেউ মহামারী হয়ে ওঠে।
সাধারণত দেখা গেছে, মানুষের শরীরে সংক্রামিত হতে পারে এদের মধ্যে আলফা ও বিটা করোনারা। এদের আবার বিজ্ঞানীরা বলেন হিউম্যান করোনাভাইরাস। এরা দু’রকম। একপ্রকার সাধারণ ফ্লুয়ের মতো, অন্যপ্রকার এপিডেমিক বা মহামারী। কখনও বা প্যানডেমিক বা বিশ্বজোড়া মহামারী।
সাধারণ হিউম্যান করোনা—HCoV-OC43 এবং HCoV-HKU1 , এরা হল বিটাকরোনার ‘এ’ লিনিয়েজ। HCoV-229E এবং HCoV-NL63, এরা আবার আলফাকরোনার বংশধর। এদের কাজ সর্দি-জ্বর-শ্বাসের সমস্যা তৈরি করা। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রামক ব্যধিও ঘটাতে পারে এরা। মূলত বয়স্ক ব্যক্তিরা আক্রান্ত হন এদের সংক্রমণে।
মহামারী হতে পারে যে করোনারা—করোনা পরিবারের তুরুপের তাস এরাই। বিশ্বে যতবার ভাইরাস মহামারী হয়েছে তার জন্য দায়ী বিটাকরোনা পরিবারের এই সদস্য বা ভাইরাল স্ট্রেনা। এরা তিনরকম সার্স-করোনাভাইরাস (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম SARS-CoV), মার্স-করোনাভাইরাস (মিডল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম MERS-CoV) এবং সার্স-সিওভি-২ (SARS-COV-2)। এরা বিটা-করোনার ‘বি’ ও ‘সি’ লিনিয়েজ। ২০০২-২০০৩ সালে সার্স মহামারী হয়েছিল বিশ্বে। ২০১২ সালে আরবে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায়, ২০১৮ সালে সৌদি আরব ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল মার্স। আর এখন বিশ্বজোড়া মহামারী এই বিটা-করোনারই সার্স-কভ-২।