দেশের সময় ওয়েবডেস্ক: কৃষক আন্দোলন যখন জেরবার মোদী সরকার, তখন বাংলা থেকে ফের সেই আন্দোলনের প্রসঙ্গ এনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘বাংলার থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম ধান কেনে কেন্দ্র। বাংলার কৃষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। কিন্তু আপনারা একেবারেই চিন্তা করবেন না, কারণ আপনাদের সব ধান রাজ্য সরকারই কিনে নেবে।’ মঙ্গলবার পূর্ব বর্ধমানের ‘মাটি উৎসব’ থেকে মমতা বিজেপি-র বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে বলেন, ‘আমার কৃষক ভাইদের বলছি, বিজেপির কিছু বড়লোক বন্ধু আছে, তারা দিল্লি সহ নানা জায়গায় গোডাউন করে ফেলেছে। এই কৃষি আইনের সাহায্য নিয়ে তারা আপনাদের সব কেড়ে নেবে। কিন্তু আমার তা হতে দেব না।’
ভোটের আবহে বিজেপি তো বটেই, সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদীও হলদিয়ায় দাঁড়িয়ে বলে গিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি প্রকল্প চালু করতে দেননি মমতা। সেই কারণে বাংলার কৃষকদের আজ বঞ্চিত হতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় বিজেপি সরকার এলে প্রথমদিনই ওই প্রকল্প চালু হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। আর এতদিন ধরে বাংলার কৃষকরা যে টাকা পাননি, সেই বকেয়া অর্থও তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।’ স্বাভাবিক ভাবেই মোদীর সেই দাবিকে নস্যাৎ করে এদিন কৃষকদের জন্য আরও ‘জনমুখী’ প্রকল্পের ঘোষণা করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘এবছর থেকে কৃষকরা ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ভাগচাষিরাও ৩ হাজার টাকা করে পাবেন।’ মমতার ঘোষণা, বাংলা শস্যবিমা যোজনা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন ফের দাবি করেন, ‘কৃষিজমিতে কোনও খাজনা নিই না। কৃষকদের উন্নয়ন সাধনই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। রাজ্যে ৭৩ লক্ষ চাষি কৃষক বন্ধু প্রকল্পের আওতায় আসবেন। ইতিমধ্যেই ৫৫ লক্ষ কৃষক নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন। কারও জমি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে করা আছে শস্য বিমা। আমাদের সরকার থাকতে আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না।’
হলদিয়ার সভা থেকে পিএম কিষান প্রকল্প নিয়ে মমতাকে নিশানা করেছিলেন মোদী। রাজ্য সরকারের কারণেই বাংলার কৃষকরা পিএম কিষান প্রকল্পের আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। মোদীর এই বক্তব্যকে অসত্য ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকার কৃষককের তালিকা যাচাই করে পাঠিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র কেন অর্থ দিচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। এই বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়েছে তা-ও বিধানসভায় সম্প্রতি তুলে ধরেন মমতা। বলেন, ‘মিথ্যে কথা বলা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদীদের। ওরা এই প্রকল্পের জন্য আলাদা পোর্টাল তৈরি করেছে। সেখানে চাষিরা নাম নথিভুক্ত করেছে। ওরা বলছে এই চাষিদের ভেরিফাই করে দাও। ছ’লক্ষ নাম নথিভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে আড়াই লক্ষ ভেরিফাই করে দিয়েছি। আমরা বলছি, চাষিদের সঙ্গে খেতমজুর ও ভাগচাষিদেরও এই সুবিধা দেওয়া হোক।’ এদিন তাই মাটি উৎসব থেকে নিজেকে ফের ‘কৃষক বন্ধু’ বলে দাবি করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
তৃণমূলে কেউ অন্যায় করলে কান মুলে থাপ্পড় দেব: কালনায় মমতা:
ষোলো সালের ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আকছার বলতেন, চোর বলে বদনাম দেবেন না। ভাল করে বললে বাড়িতে গিয়ে বাসন মেজে দেবে।
গত পাঁচ বছর এ সব কথা বিশেষ শোনা যায়নি। কিন্তু ইদানীং ফের তা শোনা যাচ্ছে। মঙ্গলবার কালনায় তারই সঙ্গে নতুন বাক্যবন্ধ জুড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “তৃণমূলের যদি কেউ অন্যায় করে, আমি আছি দাঁড়িয়ে, কান দুটো মুলে দেব, বা দু’গালে দুটো থাপ্পড় দেব। বলব তুমি এই অন্যায়টা কেন করছ। অন্যায় আমার কানে এলে আমি বরদাস্ত করব না। তাই দু’একজন ভয়ে আগে থেকেই পালিয়ে যাচ্ছে”।
আপাত ভাবে এই সব কথা শাসকের মুখে শুনতে ভালই। কিন্তু ভোট মুখে দিদির এ কথা শুনে বহু প্রশ্ন উঠছে। প্রথমত, গত পাঁচ বছরে এ ধরনের কথা কি আদৌ শোনা গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, অন্যায়ের অভিযোগ কম লোকের বিরুদ্ধে ওঠেনি, কিন্তু কতজনের কান মোলা হয়েছে, কারাই বা থাপ্পড় খেয়েছেন। তৃতীয়ত, ভোটের আগে এখন যাঁরা দল ছেড়েছেন, যাঁদের এখন মীরজাফর, বেইমান, দুর্নীতিপরায়ণ, চোর ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত করা হচ্ছে, তাঁদের দলে ধরে রাখতে কী পরিমাণ দৌত্য শাসক দলের তরফে হয়েছে তাও গোটা বাংলায় টিভির পর্দায় একপ্রকার লাইভ দেখেছে।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নানের কথায়, এ শুধু দ্বিচারিতা নয়, মিথ্যাচার। বাংলার মানুষ আর ওসব কথায় ভুলবে না।
বাংলায় শাসক দলের বিরুদ্ধে কাটমানি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট চক্র, বালি ও কয়লা পাচার, জবরদখল ইত্যাদি অভিযোগ দল নির্বিশেষে বিরোধীরা বহুদিন ধরেই তুলছেন। শহর, আধা শহর ও গ্রামে দিনের পর দিন এ ধরনের ঘটনার জেরে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অনেকের মতে, সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বেশি করে তৈরি হয়েছে স্থানীয় স্তরে। অর্থাৎ নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ। সম্ভবত সেই কারণেই পুরনো ফর্মুলার প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছে। নিচু তলার নেতাদের দেখে ভোট না দিয়ে দিদিকে দেখে দিন। যাঁরা অন্যায় করেছেন, তাঁদের তো কান মুলে থাপ্পড় মেরে সবক শেখানো যাবে। কিন্তু ভোট দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে। ২৯৪ টি আসনে তিনিই প্রার্থী।
বস্তুত প্রশান্ত কিশোরের প্রচারের দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ বছর আগে থেকেই এই ফর্মুলা চলছে। প্রশান্ত কিশোরও এতে সিলমোহর দিয়েছেন। কারণ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত কিশোরকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে পিকে বলেছিলেন, দিদির বিরুদ্ধে কি কোনও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে?