সবার জীবন এক খাতে বয় না। তাই যদি হতো, যে একদিন স্কুলের বন্ধুদের ভয়ে লুকিয়ে থাকত গির্জার এক কোণে, সে-ই স্বপ্নিল থেকে সায়শা হয়ে ‘বেশরম রং’-এ সোনা ফলালেন কী করে!
হ্যাঁ, তিনি স্বপ্নিল শিন্ডে।
ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী পোশাক শিল্পী। করিনা কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ, দীপিকা পাড়ুকোন, অদিতি রাও হায়দারির মতো অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। বলিপাড়ায় তাঁর যথেষ্ট নামডাক। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখো লাখো অনুরাগী। কিন্তু এমনটা তো ছিল না একদিন। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগতে হয়েছে তাঁকে। জন্ম ১৯৮১ সালে। মুম্বইয়ের দাদরে। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারেই বেড়ে ওঠা। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা মুম্বইয়েই।
মহিলাদের সাজ পোশাক নিয়ে আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই। সেই সূত্র ধরে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত। ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো আচরণ করতেন। এজন্য কম পিছনে লাগেননি স্বপ্নিলের স্কুলের সহপাঠীরা। ওদের ভয়ে গির্জার এক কোণে লুকিয়ে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভয় পেয়েছেন ক্লাসে ঢুকতে। স্বপ্নিল যখন পা রাখলেন কুড়িতে, তখনই বুঝতে পারলেন, মেয়ে নয়, ছেলেদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বাড়ছে। এরপর থেকেই নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে দোটানায় ভোগা শুরু। প্রথমে ভেবেছিলেন, তিনি সমকামী। এরপর চিকিৎসকদের সঙ্গে বারবার কথা বলা, থেরাপি, শেষমেশ অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত।
তাঁর কথায়, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার মধ্যে কোনও সমস্যা রয়েছে। আমার বন্ধুরা জানত না যে, আমি বন্ধ দরজার পিছনে অন্য ধরনের পোশাক পরতাম। হিল জুতো পরতাম। এমনকী মেকআপও করতাম। আমি দু’রকম পরিচয়েই বাঁচতাম। মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমি মন থেকে নারী হয়েও শুধুমাত্র পুরুষের পোশাকে সবার সামনে ঢাকার চেষ্টা করছি নিজেকে। এরপরই প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতে শুরু করি। ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ওষুধ খাই। কিন্তু নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না। আর ওভাবে অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে বেঁচে থাকাও সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে।
জীবনে শান্তি চাইছিলাম। আর তাই রূপান্তকরণের সিদ্ধান্ত নিই।’
স্বপ্নিলের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা সায়শা বলেন, ‘প্রক্রিয়া শুরুর পর অনেকে অনেক কথা বলেছিলেন। লোকজন আমাকে ভয় দেখাতেন। ওষুধপত্রের ফলে শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে আমায় বারণ করেছিলেন অনেকে। কিন্তু কারও কথায় কান দিইনি। শুধু মনের কথা শুনেছি। আর তা শুনেই অস্ত্রোপচার করাই ২০২০ সালে।’ অপারেশনের পর স্বপ্নিল হয়ে যান সায়শা। কিন্তু নামটি তাঁর পছন্দ ছিল না। তাঁর কথায়, ‘আমি নাম রাখতে চেয়েছিলাম মস্তানি। কিন্তু পরিবারের লোকজন ওই নামে আপত্তি জানান। তাঁরা সায়শা নামটিই রাখতে বলেন। সায়শা শব্দের অর্থ ‘অর্থবহ জীবন’। আর এটা তো ঠিক যে, আমি আমার জীবনকেও অর্থবহ করতে চেয়েছিলাম। ফলে শেষ পর্যন্ত সায়শা নামটিই গ্রহণ করি।’
মুম্বইয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ার পর ছ’মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে তিনি চলে যান ইতালি। তখনও অবশ্য তিনি সায়শা হননি। ইতালি থেকে ফিরে মুম্বইয়ের একটি ফ্যাশন স্টোরে সেলসবয়ের কাজ শুরু করেন। কিছুদিন কাজের পর তাঁর পদোন্নতি ঘটে। পরে ২০০৭ সালে নিজস্ব একটি সংস্থা খোলেন। সেই সংস্থার প্রচারে জোর দেন। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নামডাক হয় তাঁর।
ধীরে ধীরে বলিপাড়ার নায়িকাদের পোশাক তৈরি করতে থাকেন। ‘ফ্যাশন’, ‘গুজারিশ’, ‘লক্ষ্মী’র মতো বহু হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন পোশাক শিল্পী হিসেবে। অংশগ্রহণ করেন আমেরিকার একটি রিয়ালিটি শোয়ে। কঙ্গনা রানাওয়াত সঞ্চালিত ‘লক আপ’ শোয়েও অতিথি হিসেবে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
২০২১ সালে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে হারনাজ কউর সন্ধু যে গাউন পরেছিলেন, সেটির ডিজাইন করেছিলেন সায়শা। ‘পাঠান’ ছবির ‘বেশরম রং’ গানের দৃশ্যে দীপিকার পোশাক নিয়ে যে বিতর্ক হল, সেই গানে নায়িকার জন্য পোশাক বুনেছিলেন সায়শা। তবে গেরুয়া বিকিনি নয়, গানের শুরুতে অভিনেত্রীকে যে ক্রপ টপ ও চেনমেন স্কাট পরে দেখা যায়, সেই পোশাকটিই ডিজাইন করেছিলেন তিনি। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি ব্যবসাতেও হাত পাকিয়েছেন সায়শা। মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর রেস্তরাঁও রয়েছে।