
[তখন বাইশ বছর বয়স। বিভূতিভূষণ আমার রক্তে অরণ্যের উপন্যাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই প্রভাতে-মধ্যাহ্নে-অপরাহ্নে বাগান-প্রকৃতিতে কাজ করার পরও রাতের টহলের জন্য মন উঁচিয়ে থাকতো।]
BSc(Ag)Hons. এবং MSc(Ag) পড়ার মাঝে আমাদের একবছর সময় নষ্ট হয়ে যেতো। ছয় মাসের ফার্ম ট্রেনিং করতে হতো (এখন চার বছরের মধ্যেই তার সমরূপ কোর্স বরাদ্দ থাকায় চার বছরের মধ্যেই ডিগ্রি পাওয়া যায়, বছর নষ্ট হয় না) এবং তারপর ছয়মাস একদমই বসে থাকা। সকলের খুবই খারাপ লাগতো ব্যাপারটা। আমি এই ছয়মাসে একটি চা বাগানে ট্রেনী-ম্যানেজারের কাজ নিলাম। কারণ ঘরে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়িতে সেই বাগান। তখন চা বাগানে ম্যানেজারির কাজ সাধারণভাবে কমার্স গ্র্যাজুয়েটের ছেলেরাই পেতো৷

TEA TIME : চা নিয়ে গল্প কথা সঙ্গে অর্পিতা- দেখুন ভিডিও
আমার বাগানের যিনি মালিক ছিলেন তিনি বেলুড় মঠে দীক্ষিত একজন ভক্ত। পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে তাঁর বেশ কয়েকটি বাগান ছিল। আমি রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র বলেই সম্ভবত ইন্টারভিউ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নিয়োগপত্র দিলেন। আমার সঙ্গে ওই বাগানে আর একজন যোগদান করেছিলেন, তিনি বোটানির ছাত্র, রামকৃষ্ণ মিশন ঘরানার নন। হাওড়া স্টেশন থেকে আমাদের টিকিট কেটে দেওয়া হয়েছিল, একত্রেই পৌঁছালাম। নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে বাগানের গাড়ি এসে নিয়ে গেলো। আমরা দু’জন একসঙ্গেই যোগদান করলাম। এটাই আমার জীবনের প্রথম চাকরি। প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সময়।
বাগানটি যথেষ্ট বড় ছিল, আসাম প্রজাতির চা চাষ হত। ছিল বড়সড় একটি ফ্যাক্টারিও। সেখানে মূলত গ্রীন টি এবং সিটিসি চা তৈরি হত। চায়ের ছায়াগাছ বা শেড-ট্রী সহ ঘন সবুজ এলাকাটা কেমন অরণ্যের বাতাবরণ! সবমিলিয়ে ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভালো’। অসংখ্য পাখি ও তার ডাক, সাপ, বন্যজন্তুর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো। কখনও হাতি, চিতাবাঘ; সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
বাগানে ট্রেনী দুই ম্যানেজার মিলে একটি শুল্কমুক্ত আবাসস্থল পেলাম, সঙ্গে আরও কিছু সুযোগসুবিধা। সারাদিন মাঠে ও ফ্যাক্টারীতে কাজের পর রোজ রাতে একবার মোটর সাইকেল করে বাগান টহল দিতে হত — সমস্ত রক্ষীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কিনা, কেউ দামী শেড-ট্রী রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে কিনা; নার্সারী থেকে চায়ের চারাগুলি চুরি যাচ্ছে কিনা, চা বাগানে অবৈধ, অসামাজিক কাজ চলছে কিনা, ইত্যাদি। আমি মোটর সাইকেল চালাতে না পারায় এক বাগান বাবুর মোটরেই টহল দিতাম।
রাতের নিবিড় নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, অসংখ্য ঝিঁঝিপোকার ডাক, জোনাকির আলোকমালা, বাগানের পাকা-কাঁচা নানান রাস্তা দিয়ে চলার সময় বিষধর সাপ চলে যাওয়ার ঘটনা, হাতির দলের অবস্থিতি — সবমিলিয়ে ভয়মিশ্রিত অথচ এক অনবদ্য রোমাঞ্চকর স্মৃতি। আজ বিশ্ব চা-দিবসে (১৫ ই ডিসেম্বর) আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই চা-বনের হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যা-রাত্রিগুলি। তখন বাইশ বছর বয়স। বিভূতিভূষণ আমার রক্তে অরণ্যের উপন্যাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই প্রভাতে-মধ্যাহ্নে-অপরাহ্নে বাগান-প্রকৃতিতে কাজ করার পরও রাতের টহলের জন্য মন উঁচিয়ে থাকতো।
এই বাগানের শ্রমিকদের অনেকের সঙ্গে নকশালপন্থী নেতা কানু সান্যালের যোগাযোগ ছিল, অবশ্য কখনও পরিচয় হয় নি তাঁর সঙ্গে। সমস্ত দলের শ্রমিক সংগঠনের নেতারাই এই বাগানে যাতায়াত করতেন। বাগান-ম্যানেজারের পা সামান্য খোঁড়া ছিল। শ্রমিকদের কাছেই জানতে পারি, কোনো শ্রমিক আন্দোলনে প্রচণ্ড প্রহৃত হয়েছিলেন তিনি। তাই তিনি কখনও রাতের অন্ধকারে টহল দিতে বেরোতেন না। ওইকাজ মূলত বাগান-বাবুদের ছিল। আমরা সহকারী ম্যানেজাররাও দেখভাল করতাম। কখনও কখনও পুলিশের পেট্রোল ডিউটি চলতো। আমার সঙ্গে প্রায় সকল শ্রমিকের ভালো সম্পর্ক তৈরি হল, কিছুটা মানবিক সম্পর্কও।
মাঠে যারা পাতা তুলতেন, আগাছানাশক, কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগ করতেন, সার দিতেন — তাদের কাজে তদারকি করতে গেলে, টুকটাক কথা হত। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর গেলেই কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করতেন, ‘কা তিয়ান খালে, বাবু?’ কী সব্জি দিয়ে ভাত খেলে তুমি? খাই বা না খাই, আমিও রোজ রোজ বলতাম ‘চায়ে কোঁকড়ি’, অর্থাৎ চা বাগানে স্বাভাবিকভাবে জন্মানো বড় বড় দুধ ছাতুর তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছি। শ্রমিক মেয়েরা হেসেই খুন। ওরা মূলত সাঁওতাল, মুণ্ডা এবং কেউ কেউ নেপালি। জঙ্গলের এই কোঁরক বা ছত্রাক খেতে খুব ভালোবাসেন তারা।
আমাকেও মাঝেমধ্যে রেঁধে এনে বাটি করে দিতেন, আমিও কিছু না ভেবেই খেয়ে নিতাম, রান্নার তারিফ করতাম। ওরা সারাদিনের কাজ মনোযোগ দিয়ে করতেন। একদিন ম্যানেজার এসে দেখে ফেললেন, খুব বকা দিলেন। পরে সন্ধ্যায় সারাদিনের কাজের রিপোর্ট দিতে গেলে, উনি বললেন, ম্যানেজার হিসাবে শ্রমিকদের দেওয়া জিনিস কিছু খাবেন না, খাওয়া উচিত নয়, অঘটন ঘটতে পারে। ওই কয়েকমাসের কাজের মধ্যেই তরাই অঞ্চলের আর একটি বাগানে একটি অঘটন ঘটলো।
একটি বাগানে ম্যানেজারের কোয়ার্টার সন্নিহিত কুঁয়োতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাতে বাগানের উচ্চপদাধিকারী সহ পাঁচজন মারা যান। সেই সংবাদ কাগজে প্রকাশিত হলে, আমার বাড়িতে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হল। সমস্ত বাগানের মতো আমাদের বাগানে অবস্থিত কুঁয়োগুলির ক্ষেত্রে সুরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হল। পাহারা বসলো। আমার সেই সময় বিশ্বাস ছিল, শ্রমিকদের কেউ আমাকে খাবারে বিষ মেশাতে পারেন না; আমি এতটাই তাদের সঙ্গে সত্য সম্পর্কে মিশেছি।
তাদের বস্তিলাইনে গিয়ে অসুস্থ শ্রমিককে দেখতেও গিয়েছি। কিন্তু আজকের মতো তখনকার সামাজিক পরিস্থিতি ছিল না। আজ যেমন বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, তখনও যে তেমন হবার সম্ভাবনা ছিল, বিশ্বাস হত না। হয়তো মূল্যবোধ জিইয়ে রেখেছিল সুকুমারবৃত্তি মানুষেরা।