দেশের সময়: আজ, বৃহস্পতিবার সারদা মায়ের ১৭০ তম জন্মতিথি। এই উপলক্ষে সেজে উঠেছে বাগবাজার মায়ের বাড়ি। আলো ও ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে গোটা বাড়ি। সকাল থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেছেন ভক্তরা। শ্রীশ্রী সারদা মায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে এদিন সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দিনভর রয়েছে নানা অনুষ্ঠান।

এদিকে, বাগবাজার মায়ের বাড়ির পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সমস্ত কেন্দ্রেই দিনটি পালিত হচ্ছে। ১৮৫৩ সালে অগ্রহায়ণের কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে জয়রামবাটিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সারদা দেবী। শ্যামাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফল অর্পণ করেছেন সহধর্মিনী সারদাদেবীকে। বিবেকানন্দ তাঁকে সঙ্ঘ জননীর স্থান দিয়েছেন।

মায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে প্রতি বছরই জয়রামবাটি থেকে শুরু করে বাগবাজার মায়ের বাড়ি, দক্ষিণেশ্বর, কথামৃত ভবন, শ্যামপুকুরবাটি, আদ্যাপীঠ, কাশীপুর উদ্যানবাটি, বলরাম মন্দির, কাশীশ্বর মিত্রের বাড়ি, আলমবাজার মঠ, বরানগর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। করোনার কারণে দু’বছর ভক্তশূন্য অবস্থায় পালিত হয়েছে দিনটি। এবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ফলে ঢল নামে ভক্তদের।

বাগবাজার রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী নিত্যমুক্তানন্দ মহারাজ জানিয়েছেন, ভোর সাড়ে চারটেয় মায়ের বাড়িতে মঙ্গল আরতি দিয়ে এদিন বিশেষ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈদিক স্তোত্রাদি পাঠ ও ভজন। তাতে অংশ নেন সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিবৃন্দ। সকাল ছ’টা থেকে ন’টা পর্যন্ত যোগানন্দ হলে জপযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিল। সঙ্গে চলতে থাকে সানাই বাদন। সাতটায় বিশেষ পুজো, হোম ও শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ হয়। সাড়ে সাতটায় শুরু হয় শোভাযাত্রা।

মায়ের বাড়ি পরিক্রমা করা হয়। বেলা এগারোটা থেকে প্রসাদ বিতরণ। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রয়েছে সন্ধ্যারতি। এদিকে, সকাল ন’টা থেকে মায়ের বাড়ির পাশেই উদ্বোধন কার্যালয়ের সারদানন্দ হলে শুরু হয়েছে মাতৃসঙ্গীত। পরিবেশন করছেন সৌভিক দত্ত। শ্রীশ্রী মায়ের কথা পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠের স্বামী ধ্যানপ্রিয়ানন্দ মহারাজ। রয়েছে গ্রন্থপ্রকাশ।

এই অনুষ্ঠানে থাকবেন বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ভাবপ্রচার কমিটির আহ্বায়ক স্বামী দেবরাজনন্দজি মহারাজ। স্বাগত ভাষণ দেবেন বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ স্বামী নিত্যমুক্তানন্দ। বিশেষ বক্তৃতা রাখবেন রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শৈক্ষিক ও গবেষণা সংস্থার প্রো চ্যান্সেলর ও সম্পাদক স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দজি মহারাজ। সভাপতির ভাষণ রাখবেন স্বামী দেবরাজনন্দ। ভজন পরিবেশন করবেন অর্চন চক্রবর্তী ও কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। কালীকীর্তন পরিবেশন করবেন বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন ও সারদাপীঠের সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিবৃন্দ। রয়েছে বাউল গান। পরিবেশন করবেন সুকুমার বাউরি।

সারদাদেবী শুধু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পত্নী ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর সাধনসঙ্গী। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্ঘ জননী। ভক্তরা তাঁকে শ্রীশ্রী মা বলে অভিহিত করেন। রামকৃষ্ণদেবের ভাবধারার বিকাশ ও প্রসারে সারদা মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সারদামণি মুখোপাধ্যায় থেকে সকলের সারদা মা, এক সাধারণ নারীর মহীয়সী হয়ে ওঠার কাহিনী যেন আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস। বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ার সুবাদে পরিবারে যেমন তাঁর আদর ছিল, তেমনই ছিল দায়িত্ব ও কর্তব্য।

গদাধর চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সারদামণির। কামারপুকুরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের বধূ হয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই অর্থে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল না। তবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ের থেকে কম ছিলেন না তিনি। দক্ষিণেশ্বরে পা রেখেই শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনের নয়া অধ্যায়। স্বামীর সঙ্গে মা ভবতারিণীর নিত্যসেবা, ধীরে ধীরে রানি রাসমণির নজরে পড়া, পরিশ্রম দিয়ে সকলের মন জয় করে নেন তিনি। সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন মা সারদা। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ দিয়ে কাউকে কখনও বিচার করেননি। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই, এই মতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।


নিজের মাতৃত্ব বিসর্জন দিয়ে সকলের মা হয়ে উঠেছেন সারদা দেবী। দক্ষিণেশ্বরে অগণিত ভক্তের মুখে মা ডাক শুনে যেন প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছে তাঁর। সারদামণি থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন জগজ্জননী মা সারদা। তিনি বলতেন, আমি পাতানো মা নই, গুরু মাও নই, মুখে বলাও মা নই। আমি সত্যিকারের মা। অর্থাৎ সবাই আমার সন্তান। ছোটবেলা থেকেই কাউকে কোনওদিন অভুক্ত থাকতে দেননি। কেউ না খেয়ে রয়েছে শুনলেই অস্থির হয়ে উঠতেন তিনি। নিজের মুখের গ্রাস তুলে দিতেন তাঁকে। পরনের পোশাক থেকে সবার ভালোমন্দ, কিছুই তাঁর নজর এড়িয়ে যেত না। ত্যাগ, ভালোবাসা, সরলতা, নিলোর্ভ চরিত্র এসবই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এমনকী মার্গারেট নোবেলের ভগিনী নিবেদিতা হয়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে সারদা মায়ের বিশাল অবদান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here