দেশের সময়: হয় রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দাও। নতুবা সপরিবারে বেলারুশে চলে যাও। আর ৭২ঘণ্টার মধ্যে জানাও কী করবে। ওয়াগনার বাহিনীকে চরম সময়সীমা দিয়ে দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তাঁর এই আলটিমেটাম দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক কূটনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ফর্মে ফিরে গিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিংবা ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওয়াগনার বিদ্রোহের পর গত শনিবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
তারপর থেকে তাঁর আর দেখা মেলেনি। জল্পনা ছড়ায়, মস্কো ছেড়ে কি পালিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট? তবে বুধবার ভারতীয় সময় ভোরবেলা ফের টিভির পর্দায় ভেসে উঠলেন রাশিয়ার স্ট্রং ম্যান। প্রথমেই বললেন, ওয়াগনার গ্রুপ বলে আর কিছু থাকছে না। তারপরই দিলেন দু’টো অপশন। হয় তোমরা রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দাও। নতুবা সপরিবারে বেলারুশে চলে যাও।
কিন্তু ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে কেন এত রুষ্ট হলেন পুতিন? সূত্রের খবর, ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোঝিন ইউক্রেনের গোয়েন্দাদের চক্করে পড়ে গিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আফ্রিকায় গোপন বৈঠকও করেন তিনি। সময়টা গত জানুয়ারি। সেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল পুতিনের কাছে। সবজেনেও তিনি চুপ করেছিলেন। তারপর ওয়াগনার বাহিনীকে শেষ করে দেওয়ার জন্য চিত্রনাট্য সাজান পুতিন। তারই ফল এই বাহিনীর এই বিদ্রোহের নাটক। সূত্র বলছে, ওয়াগনার বাহিনীর কিছু সদস্য রয়েছে আফ্রিকাতেও। তাদের সঙ্গেই বৈঠক করতে গত জানুয়ারিতে আফ্রিকায় যান প্রিগোঝিন। সেখানেই ইউক্রেনের গোয়েন্দাদের চক্করে পড়ে যান তিনি।
ওয়াগনার বিদ্রোহের পর অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, পুতিনের বোধ হয় শেষের শুরু হয়ে গেল! কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট বুঝিয়ে দিলেন, প্রাথমিক ধাক্কা এলেও প্রশাসন বিশেষত সেনা তাঁর হাতেই আছে। এবং ওয়াগনারদের ভাগ্যে কী আছে, সেটাও তিনিই নির্ধারণ করবেন। পুতিন ও রাশিয়ার উপর নজর রাখে, এমন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন দাবি করেছে, ভ্লাদিমির পুতিন অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পা ফেলছেন। প্রিগোঝিনের বাহিনী তথা ওয়াগনারের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে, সব এককাট্টা করছে পুতিন।
বেশকিছু সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, ওয়াগনার বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার স্বার্থেই ধৈর্য ধরেছিলেন পুতিন। সেই কৌশল সফল হয়েছে। পুতিন ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন, ওয়াগনার বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। এবং এজন্য সেনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, রুশ সেনা কঠিন সময়ে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে। সেজন্য গোটা দেশ সেনার কাছে কৃতজ্ঞ। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোই শনিবার রাতেই জানিয়ে দেন, ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন বেলারুশেই নেমেছেন। আপাতত রাজধানীর খুব কাছেই একটি বাড়িতে তাঁর আস্তানা হয়েছে।
রুশ প্রশাসন ও বিদ্রোহী ওয়াগনার বাহিনীর মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে দু’পক্ষই। তবে কিছু পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যম ও কূটনীতিকদের অনেকেই বলছেন, পুতিন শুধু ফর্মেই ফেরেননি। একেবারে নিজস্ব স্টাইলে অপারশেন চালাচ্ছেন তিনি। তাঁরা মনে করেন, প্রথমে শত্রুদের তিনি মুক্তি দিয়ে দেন। অন্য দেশে পাঠিয়ে দেন। এটাই পুতিনের স্টাইল। কিন্তু এর কয়েক বছর পর সেই শত্রুদের লাশ কোথাও না কোথাও পাওয়া যায়।
জল্পনা উস্কে দিয়ে আমেরিকার সামরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর জি স্টাডি অফ ওয়ার বলছে, ক্রমশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা প্রিগোঝিনকে নিকেশ করতেই এসব বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।
আর বিদ্রোহের চিত্রনাট্য তৈরির মাথা পুতিনেরই। ওয়াগনার বাহিনীর একাংশের সহযোগিতাতেই তিনি এই বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করেন আড়ালে থেকে। আর এই বিদ্রোহের কথা শুনে নাকি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি প্রিগোঝিন। যদি এই বিদ্রোহের পিছনে পুতিনের কোনও হাত না থাকত, তাহলে ভাড়াটে সেনার দল কিছুতেই মস্কোর এত কাছে চলে আসতে পারত না। এমনকী সূত্রের খবর, প্রিগোঝিন এখন বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে এমন একটি হোটেলে তাঁকে তোলা হয়েছে, সেখানে নাকি একটিও জানালা নেই।
এটুকু দাবি করেই থেমেছে জি স্টাডি। তবে এই দাবির কতটুকু সত্যি তা সময়ই বলবে। তবে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহের আঁচ রুশ সেনার উপর পড়েছে, এমনটা কিন্তু মোটেই মনে হচ্ছে না। কারণ, রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই বাল্টিক সাগরে মহড়া শুরু করে দিয়েছে। সেখানে নামানো হয়েছে যুদ্ধজাহাজ। একটি দু’টি নয়। ১৪টি। যুদ্ধজাহাজের পাশাপাশি আকাশে চক্কর কাটছে সুখোই এম কে ৩৫ যুদ্ধবিমান। বাল্টিকে কিরোভ ক্লাসের যুদ্ধজাহাজ নেমেছে। পরমাণু অস্ত্র ও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নিয়ে চলছে মহড়া।
এই মহড়ায় রয়েছে রাশিয়ার ইউফায়েড কমান্ড। এদিকে বাল্টিকে যুদ্ধজাহাজের মহড়া শুরু হতেই তৎপর হয়েছে ন্যাটো। বাল্টিকে মহড়া মানেই একেবারে ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলির ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলা। এরপরই ন্যাটো বাহিনীর তরফে যুদ্ধ প্রস্তুতি ঘোষণা করা হয়েছে। সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা, রাশিয়া যুদ্ধে জড়াতে চাইলে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। রাশিয়া অবশ্য বলছে, যে কোনও পরিস্থিতিতে রুশ সেনাকে তৈরি থাকতেই বাল্টিক সাগরে ওই মহড়া শুরু করা হয়েছে।
এটা সামরিক রুশ নিরাপত্তা নীতিরই অংশ। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির একেবারে ঘাড়ের কাছে রাশিয়ার এই যুদ্ধ মহড়া মোটেই হাল্কা কোনও বিষয় নয়। এর পিছনে পুতিনের কোনও ছক রয়েছে। ওয়াগনার বিদ্রোহের পরপরই বাল্টিক সাগরে এতবড় সামরিক মহড়ার পিছনে রাশিয়ার ঠিক কী কৌশল, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। ন্যাটো কি রুশ সেনা মহড়ায় ভয় পাচ্ছে? কারণ, বাল্টিক সাগরে রাশিয়া সেনা মহড়া শুরু করতেই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, সেখানেই রুশ হামলার কথা মাথায় রেখে পাল্টা রণকৌশল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘটনাক্রম দেখে কূটনীতিকদের অনেকেই বলছেন, ইউরোপীয়ান যুদ্ধ হয়তো আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। রাশিয়া বনাম ইউরোপের যুদ্ধ হয়তো একেবারে দোরগোড়ায়। ফলে এখন ইউরোপজুড়ে যুদ্ধের ঘনঘটা। ন্যাটোতে ত্রিশটি দেশের সদস্যপদ রয়েছে। তবে ন্যাটোতে আমেরিকার প্রভাব ও গুরুত্ব সবথেকে বেশি। ন্যাটোভুক্ত কোনও দেশে হামলা হলে আমেরিকা সহ ন্যাটোভুক্ত সবক’টি দেশ সরাসরি যুদ্ধে নামতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেটাই ন্যাটোর মূল শর্ত। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে যুদ্ধ মানে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ!
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও পুতিনের হাতে এখনও অনেক ব্রহ্মাস্ত্রই মজুত, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। টেকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ারেও অন্যদের থেকে এগিয়ে রাশিয়া। ন্যাটোর হাতে ৫০ লক্ষের বাহিনী। তাছাড়া ন্যাটোর হাতে ২০ হাজার ৮৫০টি যুদ্ধবিমান। রাশিয়ার হাতে ১৪ লক্ষের বাহিনী। রাশিয়ার ঘরে ২ হাজার ২০০ যুদ্ধবিমান। ন্যাটোর কাছে ২ হাজার ১০৯ যুদ্ধজাহাজ। রাশিয়ার হাতে ১ হাজার ৫০টি সক্রিয় যুদ্ধজাহাজ। রাশিয়ার আক্রমণের মুখে বরাবর ন্যাটোর সাহায্য চেয়েছে ইউক্রেন। কিন্তু সামরিক সাহায্য দিলেও এখনও সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেয়নি ন্যাটো। সূত্রের খবর, ন্যাটোভুক্ত দেশে যোগ দিতে চেয়েছিল ইউক্রেন। আর সেটা জানার পরই তাদের উপর হামলা চালায় রাশিয়া। এদিকে বাল্টিকে রাশিয়ার দাপাদাপির পর কি ন্যাটো হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, নাকি যুদ্ধের দামামা বাজবে, এখন সেটাই দেখার।