শীতের মরশুমে উত্তরবঙ্গে কোচবিহারের রসিকবিল এখন পাখিদের স্বর্গরাজ্য। শীত পড়তেই ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি রসিক বিলে আসতে শুরু করেছে। কোচবিহার জেলার রসিক বিলকে পাখিদের স্বর্গরাজ্য তো বটেই, ভ্রমণার্থীদেরও প্রিয় এক দর্শনীয় জায়গা। যারা পাখিদের ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে শীতকালে এই বিল হল আদর্শ জায়গা। কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জের এই বিল তাঁদের খালি হাতে ফেরাবে না। ছোট্ট এই বিলে নিজের আনন্দে ঘুরতে থাকা রকমারি প্রজাতির পাখিদের দেখে মন ভরে যাবে। আবার আশপাশের গাছগুলোতে বাসা বানিয়ে তাদের অনেকে সারা বছর থেকেও যায়। চারদিকের বড় গাছ এবং অরণ্য জায়গাটাকে বেশ নিরিবিলি করে রেখেছে। শীতকালই এখানে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
রসিকবিলেই এবার হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবং বন দপ্তরের সহযোগিতায় শুরু হল পাখিশুমারি।
শনিবার সংস্থার সদস্যরা বেশ কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পাখিদের স্বর্গরাজ্যে গিয়ে নৌকায় চেপে পাখিশুমারি শুরু করেন। জানা গিয়েছে, গতবছর এখানে ৫৩টি প্রজাতির প্রায় ৬৫০০টি পাখি দেখা গিয়েছিল। এবার তার থেকে কয়েকটি প্রজাতি বেশি দেখা যেতে পারে বলে জানা গিয়েছে। সেই গণনায় এদিন অংশগ্রহণ করেন কোচবিহারের ডিএফও অসিতাভ চট্টোপাধ্যায়, হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর কো অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু, কোচবিহার জেলার পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সহ বিশিষ্টরা।
বনদপ্তরের কোচবিহারের ডিএফও অসিতাভ চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘২০২৫ সালে রসিকবিলে জল ও জলের মধ্যে থাকা পাখিদের গণনা শুরু হয়। প্রতিটি দলে চারজন করে ছিলেন। কেউ জলে নেমে, কেউ নৌকায় চেপে, আবার কেউ ডাঙা থেকে বিভিন্ন পাখিগুলোকে দেখে তা গুনে নিয়ে লিখে রাখছেন। চিহ্নিতকরণ শেষ হলে গণনা করা হবে। তবে রসিক বিলে বর্তমানে যে পরিমাণ পাখি রয়েছে তা গতবারের তুলনায় কিছুটা হলেও বাড়বে বলে আশা রাখছি’। অন্যদিকে, হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কো অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু জানান, ‘গত বছর ৫৩টি প্রজাতির প্রায় ৬৫০০টি পাখির দেখা মিলেছিল। এবারের প্রাথমিক সমীক্ষা রিপোর্ট দুই-তিনটি প্রজাতির পাখির সংখ্যা বেশি থাকার কথা বলছে’। তবে এই বছর রসিক বিলে উল্লেখযোগ্য পাখি হিসেবে ব্ল্যাক হেডেড আইবিস চিহ্নিত করা হয়।
বিগত দিনগুলিতে রসিকবিল এলাকায় এই প্রজাতির পাখি দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জলাশয়গুলিতে শীতের মরশুমে ভিড় জমাচ্ছে হাজার হাজার পাখি। কখনও নীল আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে, আবার কখনও স্থির জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। শীতকালে এই পাখিদের উপস্থিতি উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১০ জানুয়ারি থেকে উত্তরবঙ্গের ১০টি জলাশয় জুড়ে শুরু হয়েছে জলজ পাখিদের গণনার কাজ। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন এবং বনদপ্তরের সহযোগিতায় এই গণনা পরিচালিত হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গে পাখিদের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত এই বিলে দেখা যায় বিভিন্ন রকমের সারস, আইবিস, স্পুনবিল, মাছরাঙা, টিয়া এবং অন্যান্য আরও পাখি। আছে হরিণ উদ্যান এবং কুমির ও ঘড়িয়াল পুনর্বাসন কেন্দ্র। উপরি পাওনা হিসেবে এখানে রাখা আছে লেপার্ড। আছে অজগর, পক্ষীশালা এবং কচ্ছপ উদ্ধার কেন্দ্র।
কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে যায় শীতকালের ঝাঁকে ঝাঁকে আসা পরিযায়ী পাখিরা। যেমন ছোটো সরাল, বালি হাঁস, সাদা চোখের পোচার্ড, খুন্তে হাঁস, পিনটাইল, বুনো হাঁস, দাগওয়ালা মাছরাঙা, সারসের মতো ঠোঁটওয়ালা মাছরাঙা, ছোটো নীল মাছরাঙা, ছোটো করমোরেন্ট, বড়ো করমোরেন্ট, পিং হাঁস এবং আরও নানা প্রজাতির পাখি। রসিক বিলের চারদিক অরণ্যে ঘেরা। গাড়িতে এক ঘণ্টায় পৌঁছনো যায় রায়ডাক বনে। জায়গাটির সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে রায়ডাক নদী। বর্ষাকালে যা ফুলেফেঁপে ওঠে।
রসিক বিল থেকে আলিপুরদুয়ারেও ঘুরে আসা যায়। মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে। আর প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কোচবিহার শহর। সেখানকার বিখ্যাত রাজবাড়ি এবং মদনমোহন মন্দির দেখতে যান অনেকেই। কাছেই রয়েছে বাংলা-অসম সীমান্তের শহর কামাখ্যাগুড়ি। কীভাবে যাবেন রসিক বিল? হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে রেলপথে নিউ কোচবিহার রেল স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে রসিক বিল যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে হবে। রসিক বিলের দূরত্ব নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে ৩৫ কিমি। যেতে ২ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। এছাড়া শিলিগুড়ি থেকে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আলিপুরদুয়ার যাওয়া যায়। সেখান থেকে চলে যাওয়া যায় রসিক বিল। কোচবিহার শহর থেকেও রসিক বিল যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।