দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ দিল্লি সীমান্তে এক বছর ধরে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভ।কোভিড আবহে গঙ্গায় করোনা রোগীর লাশ বিসর্জন। উন্নাও নির্যাতিতাকে পুড়িয়ে খুন।অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক। হাথরসে দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণ। তার পর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেওয়া।লখিমপুরে কৃষকদের প্রতিবাদ মিছিল লক্ষ্য করে গাড়ি চালিয়ে কৃষক খুন। একের পর এক ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখে শিউরে উঠেছিল দেশ।বিরোধীরা বলেছে এবারই বিজেপি শেষ। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আর ফিরবে না বিজেপি।
ভোটারদের একটা বড় অংশও মুখে অন্তত সে রকমই বলেছেন। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁরাই অন্য কথা বলেছেন। আর বলেছেন বলেই সমীকরণ উল্টে ফের উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় এল বিজেপি। আগের বারের থেকেও বেশি ভোট পেয়ে।
এখন পর্যন্ত যা গণনা হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে ২৬৬টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশে মোট আসন সংখ্যা ৪০৩। ম্যাজিক ফিগার ২০২। তা অনেক আগেই অতিক্রম করে গিয়েছে যোগীর দল। শুধু তাই নয়, ৪৪.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকে ৫ শতাংশ বেশি। আর এখানেই উল্টে যাচ্ছে অনেক সমীকরণ।
রাজ্যের এক বিদায়ী মন্ত্রী সতীশ মাহানা দাবি করেছেন, শুধু নিজেদের কাঙ্ক্ষিত হিন্দু ভোটই পায়নি বিজেপি। সংখ্যালঘুদের ভোটও পেয়েছে। আর উন্নয়ন করেছে বলেই পেয়েছে সংখ্যালঘুদের ভোট। সত্যিই কি তাই হয়েছে?
১৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত। সেখানে পাঁচ ভাগের একভাগই থাকেন উত্তরপ্রদেশে। এই বিপুল জনসংখ্যার রাজ্যে মোট ভোটারের মধ্যে ২০ শতাংশই মুসলিম। ভোটের আগে বিজেপি–র পাখির চোখ ছিল বাকি ৮০ শতাংশ।
এমনকী একটি জনসভায় দাঁড়িয়ে স্পষ্টই সেকথা বলে দেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বলেন, তাঁর রাজ্য ৮০ শতাংশ বনাম ২০ শতাংশের ভোট দেখবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও এই মেরুকরণই উসকে দেন।
প্রচারে এসে তাঁরা স্পষ্টই বলেন, সংখ্যালঘু সন্ত্রাসবাদী খতম হলে বিরোধী সপা কাঁদে। পূর্বতন সপা সরকারের আমলে হিন্দুদের কোনও উন্নয়ন হয়নি, সেই অভিযোগও তুলেছেন। আর এসব করেই আরও একবার সাফল্য পেল বিজেপি। মুসলিম ভোটারদের ৯৫ শতাংশই ভোট দিয়েছে অখিলেশের দলকে। তাঁর দলের যত জন প্রার্থী এগিয়ে, বেশিরভাগই সংখ্যালঘু।
আর এটাই চেয়েছিল বিজেপি। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে অন্তত অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ নিজের বাক্সে পোড়া। ২০ শতাংশকে দূরে ঠেলে দিলে তবেই বাকি ৮০ শতাংশের একটা বড় অংশের মন গলবে।
সেই ৮০ শতাংশে ভাগ বসাতে কম কসুর করেনি সমাজবাদী পার্টি। সংখ্যালঘু ছাড়া যাদব ভোট এমনিতেই পায় সপা। রাজ্যের পশ্চিমে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর (ওবিসি) ভোটারদের আধিক্য। সেখান থেকেও একের পর এক নেতা যোগ দেন সপা–য়। এমনকী যোগীর মন্ত্রিসভা ছেড়ে সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন অন্তত ১০ জন।
ভাবা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে ওবিসি ভোটও এসে পড়বে সপা–র ঝুলিতে। সেই সঙ্গে অন্য ছোট দলগুলোর সঙ্গেও ভোটের আগেই কথা বলে রেখেছিলেন অখিলেশ যাদব। ক্ষমতার কাছাকাছি এলে তাঁদেরই হাত ধরে তখতে বসবেন। এমনকী কংগ্রেসকেও সেই তালিকায় রেখে দিয়েছিলেন। কখনওই দাঁত–নখ বের করে প্রাক্তন জোটসঙ্গীকে আক্রমণ করেনি সপা।তার পরেও লাভ হল না।
৪০৪–এর মধ্যে ১২৮ আসনে এগিয়ে তারা। ওবিসি নেতাদের ঝুলিতে ভরলেও ওবিসি ভোট ধরতে পারেনি সপা। সেটা গিয়েছে বিজেপি–রই ঝুলিতে। কারণ রাজ্যের ওবিসিরাও নিজেদের দেখেছে হিন্দু হিসেবেই। তাই ভোট দিয়েছে বিজেপি–কে। কাজে এসেছে মেরুকরণ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছিলেন, আগেরবারের মতো এবারও উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে ৩০০–র গণ্ডি পার করবে বিজেপি।
পুরোপুরি না হলেও কাছাকাছি চলে গেল দল। সেই সঙ্গেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বড় সুবিধা করে দিল বিজেপি–কে। মনে রাখতে হবে, এই উত্তরপ্রদেশে লোকসভা আসন সংখ্যা ৮০। উত্তরপ্রদেশ নিজেদের দখলে থাকলে ২০১৯–এর মতো ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনেও বড় সুবিধা পাবে বিজেপি। আর সেই লক্ষ্যেই গোবলয়ের এই রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিজেপি।
মেরুকরণের সঙ্গেই মিলিয়ে দিয়েছিল উন্নয়নকে। একের পর এক বিমানবন্দর, চওড়া জাতীয় সড়ক, গঙ্গার ঘাট থেকে বিশ্বনাথ মন্দির যাওয়ার করিডোর, বিনামূল্যে রেশন— কিছুরই খামতি রাখেনি। আর এখন সেই ফলই ঘরে তুলছে বিজেপি। যা গত ৩০ বছরে হয়নি, তা–ই হল এবার। পর পর দু’বার উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় এল একই দল। পর পর দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন এক জনই—যোগী আদিত্যনাথ, যা উত্তরপ্রদেশে এর আগে ঘটেনি।