অর্পিতা বনিক: যে থাকতে রোদ-জল কষ্ট দিতে পারবে না। বহু হাজার বছর আগে ছাতা ছিল শুধু রাজাদের জন্যই। সময়ের সঙ্গে বদলেছে তার আকার-ওজন। শুধু গ্রীষ্ম-বর্ষা নয়, উৎসব-ফ্যাশনেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে সে।এই গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শরীর আড়াল করতে বা ঝমঝমে বৃষ্টিতে মাথা বাঁচিয়ে পথ চলতে ছাতার মতো সঙ্গী আর নেই। ছাতা মানেই ভরসা।মাথা রক্ষার বিশ্বস্ত সঙ্গী ৷
ছাতা নিয়ে কত যে কাহিনি! রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠেও বর্ষার সঙ্গে ছাতার সখ্য— “ঘন মেঘ বলে ঋ/ দিন বড় বিশ্রী।/ শ ষ স বাদল দিনে/ ঘরে যায় ছাতা কিনে।” আবার জুতো কিংবা ঝাঁটার মতো ছাতাও ব্যবহৃত হয়েছে অস্ত্র হিসেবে। পাঠশালের দুষ্টু পড়ুয়ার উদ্দেশে লম্বা লাঠির মতো কালো ছাতা হাতে শিক্ষকমশাইয়ের হুমকি, “আজ পিঠে ছাতার বাঁট ভাঙব!” আঁকশির মতো বাঁকানো সেই সব ছাতার বাঁট দিয়ে গাছের ডাল নুইয়ে ফুল তোলা চলত, পলায়মান ছাত্রের ঘাড় ধরে টেনে আনা যেত, এবড়ো-খেবড়ো মেঠো পথে হাঁটার ছড়ির কাজও চলত।
বিশ্বের প্রথম ছাতার দোকান ‘জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স’ চালু হয় ১৮৩০ সালে। লন্ডনের ৫৩ নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এই দোকান আজও চালু আছে। ছাতা আবিষ্কারের কাহিনি অনেক পুরনো হলেও অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ছাতার আকৃতি ছিল অনেক বড়। কাঠের বা তিমি মাছের কাঁটা দিয়ে তৈরি রড ও সোনা, রুপা, চামড়া, বিভিন্ন প্রাণীর শিং, বেত ও হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি প্রায় দেড় মিটার লম্বা হাতলওয়ালা একটি ছাতার গড় ওজন হত আনুমানিক চার-পাঁচ কেজি। ১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স স্টিলের হালকা রড দিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য ছাতা তৈরি করেন। ইংল্যান্ড, বিশেষ করে লন্ডনে খুব বৃষ্টি হয়। এ জন্য লন্ডনকে ছাতার শহর বলা হয়। এক সময় বিশ্বের অনেক দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে অনেক কম খরচে ছাতা তৈরি করত। দেখুন ভিডিও
১৮৫২ সালে স্বয়ংক্রিয় সুইচের সাহায্যে ছাতা খোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন গেজ। ১৯২০ সালে প্রথম ফোল্ডিং ছাতা তৈরি করেন জার্মানির হ্যানস হাপট। ১৯৬০ সালে বানানো হয় পলিয়েস্টার কাপড়ের ছাতা। এ ভাবে সময়ের হাত ধরে রং ও নকশার বৈচিত্রে ও প্রযুক্তিগত সুবিধা-সহ ছাতায় এসেছে নানা উৎকর্ষ। ‘দি আমব্রেলা স্কাই’ প্রকল্পের আওতায় রোদ-বৃষ্টি বা যে কোনও প্রতিকূল আবহাওয়ায় মানুষের পথ-চলাকে আরামদায়ক করে তুলতে ২০১২ সালে পর্তুগালের অ্যাগুয়েডা শহরের পথে পথে শত শত রঙিন ছাতা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। রঙবেরঙের ছাতায় ঢাকা আলো-ছায়াময় সে সব রাস্তায় হাঁটতে সমগ্র বিশ্বের বহু পর্যটক আসেন।
পৃথিবী যতই জেটগতিতে ছুটুক না, কিছু কিছু বস্তুর থাকে এক সাবেকি আবেদন, ছাতা যার অন্যতম। আজও অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নেওয়ার সময় বিদায়ী-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে উপহার দেওয়া হয় একটি ছাতা। উপহারটি প্রতীকী। তুমি এত দিন প্রতিষ্ঠানকে তোমার শ্রম দিয়ে লালন করেছ, প্রতিষ্ঠানও তোমাকে দিয়েছে জীবনযাত্রা নির্বাহের নিশ্চিন্তি ও নিরাপত্তা। ছাতাটি সেই পারস্পরিক নির্ভরতা ও পরিপোষণের প্রতীক।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ছাতা তৈরি হয় ‘ছাতার রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত চিনের সোংজিয়া শহরে। এখানে এক হাজারেরও বেশি ছাতার কারখানায় এক জন কারিগর দিনে ৩০০টির বেশি ছাতা তৈরি করেন। বিদেশি ছাতার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় চাইনিজ় ছাতা ছাড়াও বার্মা, তাইল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ান ছাতারও চাহিদা আছে। কেবল বৃষ্টি বা রোদ থেকে বাঁচতে নয়, ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে নানা রং, নকশা ও কাপড়ের ছাতা। বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারের উপর নির্ভর করে ছাতার দাম।
ভালবাসায় আগলে রাখা এ-হেন ছাতাকে ভাল না বেসে কি পারা যায়? “পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হ্যায়, পেয়ার সে ফির কিউ ডরতা হ্যায় দিল?”— রাজ-নার্গিসের এই বিখ্যাত প্রেমের গানের দৃশ্যায়নে ছাতাও যে অন্যতম চরিত্র, সে কথা কি অস্বীকার করা সম্ভব!