SumitraSen:প্রয়াত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেন ,গায়িকার প্রয়াণে শোকবার্তা মমতার

0
539

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ প্রয়াত বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেন। ৮৯ বছর বয়স বাড়িতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মঙ্গলবার ভোর ৪টে নাগাদ প্রয়াত হন তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্তে ল্যান্সডাউনের আবাসনে ছিলেন।

গত ২১ ডিসেম্বর থেকে কলকাতার মিন্টো পার্কে এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকালই তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্য জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন বিশিষ্ট গায়িকা। সম্প্রতি নিউমোনিয়াও ধরা পড়ে। ফুসফুসে সংক্রমণ ছিল। পরিবারের লোকজন শেষ সময়ে তাঁকে বাড়িতেই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর প্রয়াণে শোকবার্তা জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানালেন, ‘বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেনের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অগ্রগণ্য শিল্পী সুমিত্রা সেন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নিজস্ব গায়কিতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। প্রশিক্ষক হিসাবে তিনি অগণিত গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী রেখে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’ প্রদান করে। সুমিত্রা সেনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাঁর প্রয়াণে সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি সুমিত্রাদির দুই কন্যা ইন্দ্রাণী ও শ্রাবণী এবং সুমিত্রাদির পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমে যা জানালেন,- সুমিত্রা সেন নেই।

একটি যুগের অবসান বা ঘরানার অবসান বলব না। বলব, এক প্রজন্মের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্পী চলে গেলেন। খুব মজার কথা, একটা সময় দিদি আমার শিক্ষিকা ছিলেন। আমি আর আমার স্ত্রী ওঁর কাছে রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা করেছি। ৮-১০টি রবীন্দ্রগান ওঁর থেকে শেখা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হলেও খুব যত্ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শিখিয়েছেন। আমার গুরুও বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভাল করে বুঝতে গেলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে হবে।

মজার ব্যাপার, একটা সময় ওঁর ছাত্র ছিলাম আমি। ঘটনাচক্রে ওঁর বড় মেয়ে ইন্দ্রাণী আমার ছাত্রী হয় পরে। পার্য়াই তখন দুই বাড়িতে অনায়াস যাতায়াত ছিল। দিদি অনেক দিন আমার গান বসে বসে শুনতেন। আর বলতেন, ‘‘তোমার থেকে শুনে শুনে শিখছি।’’ অহঙ্কার কাকে বলে, জানতেনই না দিদি। দিদি বলে ডাকতাম ঠিকই। কিন্তু আদতে উনি যেন মাতৃস্থানীয়া ছিলেন। মায়ের মতো স্নেহ করতেন। ধীরেসুস্থে কথা বলতেন। কোনও চপলতা, চাঞ্চল্য নেই।

সুমিত্রা সেন কিন্তু শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন না। ভজনও গাইতেন না। সেই যুগে গুরুমণ্ডলী বলে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হত। সেখানে হেমন্ত্ মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে সুমিত্রাদিও ভজন গাইতেন। ছআয়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত জনপ্রিয় করার মূলেই ছিল ওঁর গায়কী, কণ্ঠস্বর। আর একটি বিষয়, শিল্পী নিজের ভুল নিজে ধরতে পারতেন। সে সময়ে যে ক’জন হাতেগোণা শিল্পী নিজেদের সমালোচনা করতেন তাঁদের অন্যতম সুমিত্রা সেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন তো। তাই ‘আমরা’র বদলে ‘তোমরা’কে আঁকড়ে বাঁচতে শিখেছিলেন।

শিবাজী চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে যা জানালেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার আমার দেখে যে দু’জন কাণ্ডারি তাঁদের একজন সুমিত্রা সেন।

সেই সময় কলেজ সোশ্যালে আধুনিক গানের রমরমা। সেখানে দাপিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন সুমিত্রাদি এবং সাগর সেন। ওঁরা মঞ্চে উঠনে পিন পড়লেও শোনা যেন। বলতে পারেন, সেই সময়ের রবীন্দ্রগানের দুই জনপ্রিয় তারকা!

আরও একটা ব্যাপার ছিল। সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে জনপ্রিয় করেছিলেন সুমিত্রা সেন। দুই সেনের এই মিতালিও দেখার মতো। ‘গৃহদাহ’ ছবিতে মহানায়িকার লিপে দিদি গেয়েছিলেন। সঙ্গীত পরিচালনায় রবিন চট্টোপাধ্যায়। ওই গান সেই সময়ে সবাই খুব শুনতেত। সোশ্যালে আর ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানকে যিনি পরিচিত করেছিলেন সেই মানুষটি ব্যক্তিগত স্তরে একেবারে সাদামাঠা ছিলেন। ভীষণ অমায়িক। কোনও অহঙ্কার নেই। কিছুদিন ওঁর গোয়াবাগানের বাড়িতে গানও শিখেছি। ওঁর গানের স্কুলে ভর্তি হব বলে গিয়েছি। দিদি ডেকে নিয়ে চললেন ফাংশানে। সেখানে কোরাস গাইলাম। এভাবেই ভর্তি হলাম দিদির স্কুলে।

পরবর্তীতে আমিও ফাংশান করি। সুমিত্রা সেন। নিয়মিত দেখা হত। কথাও হত। আমরা আড্ডা দিতাম খুব। যেন আমার নিজের দিদি। শেষ দিকে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। গাইতে পারতেন না। অনেক দিনই লোকচক্ষুর অন্তরালে। একজন শিল্পীর কাছে এর থেকে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে? তবু, কেউ একেবারে চিরতরে মুছে যাবেন, এটা মেনে নেওয়া যন্ত্রণার। আমি এখন দিদিকে হারানোর যন্ত্রণায় দীর্ণ।

অরুন্ধতী হোমচৌধুরী বললেন, রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হয়েছি।

গান নিয়ে পড়োশোনা করব। পেলাম সুমিত্রা সেনকে। ওঁর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিতাম। তাছাড়া, কলেজে দিদি ক্লাসও নিতেন। এমন ‘মাইডিয়ার’ শিক্ষক আমি জীবনে পাইনি! বন্ধুর মতো আড্ডা দিতেন। আড্ডা দিতে দিতেই ক্লাস নিতেন। একবারও মনে হত না, উনি শিক্ষক। আমরা ছাত্র-ছাত্রী।

ধীরে ধীরে পরিচয়ের গণ্ডি আরও বাড়ল। ওঁর বাড়িতে গিয়েছি অনেকবার। দুই মেয়ে ইন্দ্রাণী, শ্রাবণী। ভীষণ অমায়িক, শিক্ষিত পরিবার। মেয়েরা মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত। শেষের দিকে অবশ্য অনেকদিন দিদিকে দেখতেযেতে পারিনি। ইন্দ্রাণীর থেকে ফোনে খবর নিতাম। বার্ধক্যের কারণে গলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গাইতে পারতেন না। এটা বড় আফসোস। আবার এটাও ঠিক, সুচিত্রা মিত্র-কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্বকীয়তা তৈরি করেছিলেন দিদি। ওঁদের তিনজনের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত।

একদম অন্য ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উপস্থাপিত করেছিলেন সুমিত্রাদি। তাই ওঁর গাওয়া গান এত জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেক দিন গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। যা আদতে এই বিশেষ ধরনের গানের দুনিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। দিদি নেই। মন ভাল নেই। ‘আলো’ ছবিতে আমায় দিয়ে অনেকগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। দিদির আমার গান, গলা পছন্দ ছিল। তাই গানগুলো শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। ওঁর স্বভাবের মিষ্টত্ব ছায়া ফেলত ওঁর কণ্ঠেও। সুমিত্রা সেনের মতো এত আন্তরিক শিল্পী আর হবে না।

সুমিত্রা সেন সম্পর্কে ইমন চক্রবর্তী যা বললেন:

শ্রদ্ধেয়া শ্রী সুমিত্রা সেনকে আমি ‘আম্মা’ বলে ডাকতাম। ওঁর চলে যাওয়া অনেকটা আমার কাছে মাথার উপর ছাদ চলে যাওয়ার মতো। আমি খবরটা আপনাদের থেকেই প্রথম পেলাম। আমি অবশ্যই রুপুদির (শ্রাবণী সেনের ডাক নাম) সঙ্গে যোগাযোগ করব এবং যাওয়ার চেষ্টা করব।

অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মানুষটাকে ঘিরে। আমার জীবনের প্রথম রিয়্যালিটি শো ‘রবিকিরণ’-এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে শ্রী সুমিত্রা সেন বিচারক ছিলেন। আমরা যাঁরা ফাইনালিস্ট ছিলাম, সকলে একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলাম। আমাদের অনেক টিপস দিতেন আম্মা। আমি কয়েকদিন রুপুদির কাছে গানও শিখেছিলাম। সেই হিসেবে কিছু টিপসও পেয়েছিলাম। সত্যি খারাপ লাগছে খবরটায়। আমার মনে হচ্ছে যে, একটা প্রজন্মের সমাপতন হল।

রবীন্দ্রনাথের গানের ‘গোল্ডেন এরা’র সমাপতন হল। আম্মা প্লেব্যাকেও গান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের। আসলে তাঁর গাওয়া গানের একটা ইউনিকনেস ছিল। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের গান যাঁরাই গাইতেন, তাঁদের মধ্যে ম্যানারিজ়ম ছিল। ‘সো কল্ড’ রাবীন্দ্রিক টাচ থাকত। কিন্তু সেই ম্যানারিজ়মেও আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছিলেন আম্মা। সেই একই ধারা আমরা সাগর সেনের গানেও পেয়েছি। একই ভাবে আবার শ্রাবণীদির গানেও পাই। সেই জন্যই আপামর শ্রোতার কাছে আম্মার গান একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে।

সুমিত্রা সেনের চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। আবার এটাও বলব, তিনি তাঁর জীবনের সম্পূর্ণটা বেঁচেছেন। তিনি গানের মধ্যে বেঁচেছেন। তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য়া হোন। যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।

Previous articleD.EL.ED: ডিএলএড কোর্সে ভর্তি নেওয়া যাবে না এখন, নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
Next articleBangaon News:বনগাঁয় জেলা বইমেলা উদ্বোধনের কাউন্ট ডাউন শুরু, মেলা নিয়ে গানও লিখলেন বই প্রেমীরা: দেখুন ভিডিও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here