
আইপিএল জয়ের উন্মাদনা। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের ভিতরে চলছে বিরাটদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান দেখতে আরসিবি ভক্তদের উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। স্টেডিয়ামে যা মানুষ ঢুকতে পেরেছিলেন, বাইরে ছিলেন আরও বেশি। হুড়োহুড়ি থেকে পদপিষ্টের ঘটনায় মৃত ১১ জন। আহত অন্তত ৫০। এমনটাই দাবি করেছে এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম।

আইপিএল জয়ের উৎসব বদলে গেল বিষাদে ট্রফি নিয়ে জয়োৎসবে বেরিয়েছিল আরসিবি৷ হাজির হয়ঘরের মাঠ চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামেআর বাইরে হাজির দর্শকদের ভিড়ে তৈরি বিশৃঙ্খলায় পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ১১ সমর্থক।

বেসরকারি সূত্রের খবর, মৃতদের মধ্যে ছ’বছরের শিশুকন্যাও রয়েছে।আহত অন্তত ৫০। তাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।তাঁদের বোরিং হাসপাতাল ও বৈদেহী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তবু থামল না বিজয় উৎসব! বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে যখন স্বজন বিয়োগের আর্তনাদ, তখন ভিতরে আইপিএল ট্রফি নিয়ে উল্লাস বিরাট কোহলিদের। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরও স্টেডিয়ামের ভিতরে শিল্পীর চোখ বন্ধ করে বেহালা বাজানোর দৃশ্য বহু দিন দগদগে হয়ে থাকতে পারে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।

লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের চাপ সামলাতে দিশেহারা বেঙ্গালুরু পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠি চার্জ করতেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। তবু বন্ধ করা হয়নি উৎসব। পরিকল্পনা মতোই স্টেডিয়ামের ভিতরে চলতে থাকে অনুষ্ঠান। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর টিম বাস জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়েই স্টেডিয়ামের পৌঁছোয় বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তার আগেই ঘটে গিয়েছে বিপত্তি। অনুষ্ঠান দেখার জন্য বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কর্নাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের তরফে। কিন্তু অনুষ্ঠান দেখতে কয়েক লক্ষ মানুষ চলে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ কর্মীর সংখ্যা ছিল অনেক কম। ফলে ভিড় সামলাতে নাজেহাল অবস্থা হয় তাঁদের। এর পর স্টেডিয়ামের গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষ দ্রুত ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। শুরু হয়ে যায় ছোটাছুটি। তাতেই বড় বিপত্তি ঘটে যায়। অন্তত সাত জনের মৃত্যু হয়েছে পদপিষ্ট হয়েছে। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। অসুস্থদের রাস্তাতেই সিপিআর দিতে দেখা যায়। এর পরও কী ভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্ঘটনার খবর আরসিবির ক্রিকেটারেরা সম্ভবত জানতেন না। তাঁদের আচরণে বা মুখে-চোখে তেমন কোনও উদ্বেগ দেখা যায়নি।

কোহলিরা যখন কর্নাটক বিধানসভায় সংবর্ধিত হচ্ছিলেন, সেই সময় পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে। খবর পৌঁছতেই সেখান থেকে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হন কর্নাটকের উপ মুখ্যমন্ত্রী ডিকে শিবকুমার। তিনি বলেন, ‘‘বহু মানুষের ভিড় হয়েছে। সকলেই খুব আবেগপ্রবণ। পুরো রিপোর্ট না পেলে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। নিরাপত্তার জন্য আমরা ৫০০০ পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছিল। পুলিশ কর্মীর সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে।’’ কিন্তু তিনি বিতর্ক এড়াতে পারলেন না। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে পৌঁছোনোর পর মাঠের মাঝে তৈরি মঞ্চে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন কোহলিদের সঙ্গে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন মধ্যমণি হয়ে। স্টেডিয়ামের বাইরে যখন আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য একের পর এক অ্যাম্বল্যান্স আসছে, তখন কর্নাটকের উপমুখ্যমন্ত্রীকে উদ্ধার কাজে তদারকি করতে দেখা যায়নি।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্টেডিয়ামের সামনে ভিড় যাতে আরও বৃদ্ধি না পায়, তা নিশ্চিত করতে একাধিক পদক্ষেপ করে প্রশাসন। স্টেডিয়ামে যাওয়ার প্রায় সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামে যাওয়ার মেট্রো পরিষেবা।
কুব্বন পার্ক স্টেশন থেকে ড. বিআর আম্বেডকর বিধানসভা স্টেশন পর্যন্ত মেট্রো চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয় বিকাল ৪.৩০ মিনিট থেকে। লক্ষ লক্ষ আরসিবি সমর্থক আসতে পারেন এমন সম্ভাবনা ছিলই। বুধবার সকালেই বেঙ্গালুরু পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়, যাঁদের কাছে স্টেডিয়ামে ঢোকার টিকিট বা পাস রয়েছে, তাঁরাই যেন শুধু আসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কান দেননি কেউই।

হুড়োহুড়ি ও দুর্ঘটনার ঘটনার জেরে আরসিবি শিবির ওপেন-বাস প্যারেড ইতিমধ্যে বাতিল করেছে। বিরাট কোহলিরা স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছে সাধারণ বাসে। বাইরে যখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তখন মাঠের ভেতর উদযাপন চলছে! বিরাট সমর্থকদের সামনে ট্রফি মেলে ধরেছেন, হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন বাকি ক্রিকেটাররাও।
কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া বলেন, ‘অত্যধিক ভিড় ছিল। জনতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমরা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সময়ই পাইনি। উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার বলেন, ‘আমরা ৫ হাজার পুলিশকর্মীর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চা বাচ্চা উৎসাহী ছেলেমেয়ের উপর লাঠি চালানোর নির্দেশ দিতে পারিনি।‘

এদিন বিকেলে হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের বিমানবন্দরে এসে নামে টিম আরসিবি। সেখানে খেলোয়াড়দের স্বাগত জানাতে যান শিবকুমার। উচ্ছ্বসিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ কর্তারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত জরুরি বৈঠকও সারেন। কিন্তু সকাল থেকে গোটা শহর জুড়ে ছিল তুমুল উন্মাদনা।
পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনায় জুড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িও। কর্নাটকের কংগ্রেসি সরকারকে এই গণমৃত্যুর দায়ী ঠাউরেছে বিরোধী দল বিজেপি। দলের তরফে অমিত মালব্য একটি ট্যুইট করে লিখেছেন, ‘এই ট্র্যাজেডি অপরাধমূলক গাফিলতি। কংগ্রেস সরকার দু’হাতে রক্ত মেখেছে। শুধুমাত্র গাফিলতির কারণেই এতগুলি মানুষ জীবন দিয়েছেন। এটা কোনও দুর্ঘটনাই নয়, সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।‘

কর্নাটকের উপমুখ্যমন্ত্রী ডিকে শিবকুমার আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। তিনি জানিয়েছেন, ‘ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।’ তবে ভক্তদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা অস্বীকার করেছেন শিবকুমার।