সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজার শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি বাতিলের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছিলেন ৭ এপ্রিল তিনি চাকরিহারাদের সঙ্গে কথা বলবেন। সেই কথা মতোই সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে হাজির হয়েছিলেন মমতা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী চাকরি গিয়েছে, সোমবার তাঁদের বড় রকমের বরাভয় দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মুখ্যমন্ত্রী পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিলেন, তিনি বেঁচে থাকলে কোনও যোগ্য প্রার্থীর চাকরি যাবে না।
মমতার কথায়,“পরিষ্কার করে বলছি কোনও রাখঢাক নেই, যাঁরা যোগ্য তাঁদের চাকরি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কোনও রাখঢাক নেই। সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম মেনেই করব”। কীভাবে তা করবেন তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি শুধু এটুকু বলেন, “পথ হারিয়ে গেলে নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যায়। পথে চলতে গেলে ভাঙা রাস্তা আসতেই পারে। সেই রাস্তা পেরিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমাদের প্ল্যান এ রেডি, বি রেডি, সি রেডি, ডি রেডি, ই রেডি”।

এদিন নেতাজি ইনডোরে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন কয়েকজন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী। তাঁদের অন্যতম ছিলেন সাহিত্যিক আবুল বাশার ও সুবোধ সরকার। বক্তৃতায় আবুল বাশার বলেন, “যাঁর যা নেই সে তা দিতে পারেন না। তাঁর কাছে চাইতে হবে যিনি দিতে পারেন। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চাইতে হবে। আমাদের বুকে হৃদয় দিয়েছেন। তিনিই ব্যবস্থা করবেন। এ ব্যাপারে আমার একশ শতাংশ আস্থা রয়েছে। তাঁকে যেন সারা জীবন শ্রদ্ধা করে যেতে পারি”।

এর পরই মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠে, এ ব্যাপারে তাঁর সরকারের পরিকল্পনার কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়,“একটি কলমের খোঁচায় যাঁদের জীবন সঙ্কটে এসে পড়েছে। ভাববেন না আমরা এটা ভালভাবে মেনে নিয়েছি। আপনাদের শোকে আমরাও পাথর হয়ে গেছি”।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফ বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু বলেনি যে কে যোগ্য কে অযোগ্য। রাজ্য সরকারকেও সেই বাছাবাছির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের কাছে ক্লারিফিকেশন তথা ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, সুপ্রিম কোর্টের কাছে সরকার সেই ব্যাখ্যাই চাইবে। এ ব্যাপারে আইনি লড়াইয়ের জন্য সরকার কোন কোন আইনজীবীর সাহায্য নেবে তাও স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরা হলেন, দুই চার পোড় খাওয়া আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, রাকেশ দ্বিবেদী ও প্রশান্ত ভূষণ। সেই সঙ্গে থাকবেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তা ছাড়া কিছু পেশাদার আইনি ফার্মেরও সাহায্য নেওয়া হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সম্মান করি। তবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সবরকম আইনি সাহায্য নেব, যাতে যাঁরা বিপদে পড়েছেন তাঁদের সুরাহা দেওয়া যায়”। তাঁর কথায়, “প্রথমে একটা ব্যাখ্যা চাইব। যাঁরা এখনও চাকরি করছেন, তাঁরা আজকে কী করবেন? আপনারা যে বললেন (পড়ুন সুপ্রিম কোর্ট), নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে লিস্ট বানাতে—আমাদের জানতে হবে, যাঁরা ছাত্রদের পড়াতেন, স্কুল চালাতেন, আজও স্কুলে যাচ্ছেন, তারা কী করবেন। স্কুল কে চালাবে?”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ধরা যাক সুপ্রিম কোর্টে ব্যাখ্যা চাওয়ার পরেও বলা হল, পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত কাউকে চাকরিতে রাখা যাবে না। অর্থাৎ নেতিবাচক উত্তর এল। তাহলে কী করব?
মমতার কথায়, “সেটা এখনই বলব না, আমার মাথায় আছে। তবে আমি আশা করছি প্লাস হবে। অর্থাৎ যাঁরা যোগ্য তাদের চাকরি কেড়ে না নিয়ে তাঁদের কাজ করতে দেবেন”।

এ প্রসঙ্গেই তাঁর এ-বি-সি-ডি-ই প্ল্যানের কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে বলেন, ধরুন সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল, যে ওরা কোনও সুরাহা দেবে না। “তাহলেও মনে রাখবেন, বিকল্প যা করার আমরা করব। সেক্ষেত্রে আপনারা যাতে আবার চাকরি ফিরে পান তার ব্যবস্থা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই হবে। কারণ, আপনাদের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অতিরিক্ত সুরাহা তাঁরা পাবেন, যাঁরা দশ বছর ধরে কাজ করছেন”।
মুখ্যমন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, তখন নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ছত্রে ছত্রে হাততালি পড়ে। যোগ্য প্রার্থীদের অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার হয়। অনেকের মনে আবার প্রশ্নও তৈরি হয়, ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে হবে? তা ছাড়া শিক্ষকের পাশাপাশি অশিক্ষক কর্মচারীদের মনেও প্রশ্ন তৈরি হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের উদ্দেশে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টকে বলব যোগ্য অযোগ্যদের তালিকা আমাদের হাতে তুলে দিন। আপনাদের ভিক্ষা করে খেতে হবে না। আপনারা কী ভেবেছেন, আমি এত বোকা, যাঁরা অযোগ্য নয় তাঁদের চাকরি যেতে দেব? কোনও ব্যাখ্যা না পেলে আগে পিছে সব ভরাট করে দেব”।
শুধু যোগ্য নয়, অযোগ্যদেরও এদিন ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগে যোগ্যদের ব্যাপারটা দেখি। তার পর অযোগ্যদের ব্যাপারটাও দেখব। সেটা দেখব সেকেন্ড ফেজে। কাকে অযোগ্য বলেছে, কেন বলেছে, কোন কোন এজেন্সি তদন্ত করেছে সে সব দেখব”।
এদিন মমতার সঙ্গে নেতাজি ইন্ডোরের বৈঠকে ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, সাহিত্যিক আবুল বাশার, কবি সুবোধ সরকার। উপস্থিত ছিলেন আরও কয়েকজন সরকারি কর্তা, আইনজ্ঞরা। প্রথমে চাকরিহারাদের প্রতিনিধিরা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তাঁদের দাবিগুলি তুলে ধরেন। এরপরেই তাঁদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর এদিনের বক্তৃতার সরকারের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে যেমন একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছে। তেমনই বোঝা যাচ্ছে এর প্রতিক্রিয়াও হবে অনিবার্য। এখন দেখার পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়।
