ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম কোনো সরকার প্রধান হিসেবে দিল্লির মাটিতে পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোদির নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাই আবারও প্রথম কোনো সরকার প্রধান হতে যাচ্ছেন, যিনি আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন৷
কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, ঈদের ঠিক পরপরই এই সফর আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে দু’পক্ষ থেকে। আশা করা হচ্ছে, সফরটি তিন দিনের হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই জল্পনা-কল্পনা চলছিল কূটনৈতিক আঙিনায়৷
তবে শুক্রবার (১৪ জুন) সকালে দেশের সময়কে এই সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে শেখ হাসিনার কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০ জুন শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি যাবেন এবং ২২ জুন তার ঢাকায় ফেরার দিনক্ষণ ঠিক রেখে, কার্যসূচি তৈরি করছে বাংলাদেশের পিএমও এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
সূত্র জানাচ্ছে, ২১ এবং ২২ জুন নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটাবেন হাসিনা৷ সহজাতভাবেই বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকার প্রধানদের ঢাকা-দিল্লি সফরে আলোচ্যসূচিতে থাকে একগুচ্ছ ইস্যু। এবারও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নতুন সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আলাদা করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় চাইতে পারেন বলে ধারণা কূটনীতিকদের৷
‘প্রতিবেশিই প্রথম’ নীতিতে, একই মাসে দু’-দুবার উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের সফরের বিষয়টিকে ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রের দাবি, তিনদিনের এই সফরটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। কেননা গেলো মে মাসে ভারতে লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন দিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসে পররাষ্ট্র সচিব ভিনয় কোয়াত্রা, দ্বিপাক্ষিক সফরের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেছেন। আবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং শেখ হাসিনার কাছে বেইজিং যাওয়ার আমন্ত্রণ অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন।
এর মধ্যেই মোদির শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে গেলো ৮ হতে ১০ জুন হাসিনা ভারত সফর করেন। রাষ্ট্রাচারের ফাঁকে একান্ত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা। নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি একে অপরকে সুবিধাজনক সময়ে সফর করার আমন্ত্রণ জানান তাঁরা। যদিও সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দিল্লিতে এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে শিগগিরই আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবে বাংলাদেশ। তবে তখন দিনক্ষণ জানাতে পারেননি হাছান মাহমুদ।
এসব দূতিয়ালি চলার মধ্যেই ১২ জুন ভারতীয় গণমাধ্যমে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেই গুঞ্জন স্থায়ী হয়নি একদিনের বেশি। অবশেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দিল্লিতে যাচ্ছেন মোদি সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে।
এই সফরে ঠিক কি কি বিষয় আলোচনায় ঠাঁই পেতে যাচ্ছে, সেটি এখনও চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মকর্তারা বলছেন, দুই প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে বৈঠকে বসলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু অমীমাংসিত ইস্যুর অবতারণা ঘটেছে অতীতে, এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। এর পাশাপাশি গেলো এক দশকে মোদি-হাসিনা সরকারের একযোগে কাজ করার ফলে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন ‘অনন্য উচ্চতায়’। সেই সুবাদে এবারের বৈঠকেও বহুমাত্রিক বিষয়গুলোই, বিশেষত আগামী দিনের যৌথ পরিকল্পনার ইস্যু আলোচনায় গুরুত্ব পাওয়ার কথা।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আসে। সংযুক্তি, বিদ্যুৎ সহযোগিতা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হলেও কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। ভারতের অগ্রাধিকার হচ্ছে নিরাপত্তা এবং সময়ের পরিক্রমায় সেটি বাংলাদেশ নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে পানি এবং এ ক্ষেত্রে তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন নিয়ে জটিলতা এখনো কাটেনি। এ ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যা এবং বাণিজ্যের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা নিয়েও জটিলতা রয়েছে।
সংযুক্তির ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী পাওয়ার প্লান্টকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, ভারত ও জাপানের মধ্যে সংযুক্তি সহযোগিতার সম্ভাবনা থেকে শুরু করে নেপাল থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানিও করছে বাংলাদেশ।
সংযুক্তির ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আগামীতে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা থেকে শুরু করে নেপাল এবং ভুটানের জলবিদ্যুৎ ভারতের মধ্য হতে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রেও ভারতের চূড়ান্ত সম্মতির ইস্যু এবার প্রাধান্য পেতে পারে হাসিনা-মোদি বৈঠকে।
সবশেষ, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে বিশেষ আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লি সফর করেন হাসিনা৷ যদিও সেটা ঠিক দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে হাসিনা দিল্লিতে শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর করেন।
এদিকে, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ব্যাপক সমালোচিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে হাসিনাকে চীন সফরে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে দেশটি। গত রমজানের মধ্যেও হাসিনাকে চীন সফর করার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে জুলাইয়ে আরেক দফা চীনের পক্ষ থেকে তাঁকে বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন হাসিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে বেইজিং সফরে যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।