দেশের সময়, কলকাতা: হাজার হাজার কোটির দুর্নীতির কালো টাকা ‘সাদা’ করার কাজ করত বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যের সংস্থা! রেশন দুর্নীতির তদন্তে নেমে এমনটাই সন্দেহ করছে ইডি।
তদন্তে শঙ্করের নামে ৯০টি বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থার হদিশ পেয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ইডির সন্দেহ, এই সমস্ত সংস্থায় মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ( বালু নামে পরিচিত) তো বটেই, এ ছাড়াও আরও অনেক প্রভাবশালী টাকা ঢালতেন এবং কালো টাকা সাদা করতেন। এমনটাই তথ্য উঠে আসছে ইডির তদন্তে ৷
রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলায় সোমবার আবারও ইডির হানা। এবার একসঙ্গে ৪টি জায়গায় হানা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কর্তাদের। তার মধ্যে যেমন রয়েছে বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা এই মামলায় ইতিমধ্যেই ধৃত শঙ্কর আঢ্যর অফিস, তেমনই রয়েছে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে তাঁর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অরবিন্দ সিংয়ের অফিসও। সেক্টর ফাইভের ওই অফিসের ১২ তলায় চলছে তল্লাশি। গোটা চত্বর ঘিরে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। সন্দেশখালিকাণ্ডের ১০ দিন পর ফের রেশন বণ্টন দুর্নীতির মামলায় ফের তল্লাশিতে নামলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আধিকারিকরা।
প্রসঙ্গত, রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যেই উদ্ধার করা হয়েছে একটি মেরুন ডায়েরি। তাতে পাওয়া বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলেই দাবি ইডি সূত্রে। রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাসের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ওই ডায়েরিটি। ইডি সূত্রে খবর, তাতে পাওয়া গিয়েছে লেনদেনের হিসেব। সূত্র মারফৎ আরও জানা গিয়েছে, অভিজিৎ দাস ইতিমধ্যেই বয়ান দিয়েছেন যে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নির্দেশেই টাকা নিয়েছিলেন তিনি।
এরপরেই ইডি আধিকারিকরা তদন্ত করে সেক্টর ফাইভে শঙ্কর আঢ্যর ওই চার্ডার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট অফিসের খোঁজ পান। সেই মতো এদিন তল্লাশি চালানো হয়েছে ওই অফিসে। ওই অফিসের তলায় নিরাপত্তায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। এমনকী মহিলা জওয়ানদেরও সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
অন্যদিকে নিউ মার্কেটের কাছে চৌরঙ্গি লেনে এসআর আঢ্য ফিনান্স প্রাইভেট লিমিটেডের অফিসেও চলছে ED-র অভিযান। এটি শঙ্কর আঢ্যর ফোরেক্স কোম্পানি বলে দাবি ইডির। আগের দিন এই অফিস সিল করে দিয়ে যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি। কেন্দ্রীয় এজেন্সির দাবি, শঙ্কর আঢ্যর এই ফোরেক্স কোম্পানির মাধ্যমে রেশন দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। কালো টাকা সাদাও করা হয়েছে শঙ্করের এই কোম্পানির মাধ্যমেই। ইডির দাবি ফোরেক্স কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা বিনিময় নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয়নি।
কী ভাবে চালিত হত এই প্রক্রিয়া? তদন্তে পাওয়া নথিপত্র থেকে ইডির ধারণা, শঙ্করের এই সংস্থাগুলিতে কম করে ২০ হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছে বিদেশি মুদ্রায় বদল করানোর জন্য। এর মধ্যে ৯-১০ হাজার কোটি টাকা একা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়ের। ইডি সূত্রে খবর, বাকি টাকা কারা জমা করছেন, কী তাঁদের পরিচয়, বিদেশে যাচ্ছেন কি না, গেলে কোথায় যাচ্ছেন, তার কোনও যথাযথ নথি নেই।নেই পাসপোর্টের তথ্যও। ইডির ধারণা, অনামী এই সমস্ত লেনদেন হয়েছে প্রভাবশালীদের আড়ালে রেখেই।
সোমবার কলকাতার বেশ কিছু এলাকায় শঙ্করের এই সমস্ত বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থার দফতরে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে ইডি। এর আগেও গত ৫ জানুয়ারি শঙ্করের কিছু সংস্থার নথিপত্র খতিয়ে দেখেছে তারা। কথা বলেছে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চাওয়া এক সাক্ষীর সঙ্গেও। ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সাক্ষীই এই বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত বহু তথ্য দিয়েছেন ইডিকে।
ইডি জানতে পেরেছে, জ্যোতিপ্রিয়ের ৯-১০ হাজার কোটি টাকার বদলে সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশের সংস্থায় বিনিয়োগও করা হয়েছিল। ইডি সূত্রে খবর, বেআইনি ভাবে এই ২০০০ কোটি টাকা দুবাইয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিছু টাকা সরাসরিই দুবাইয়ে পাঠানো হয়। বাকিটা যায় বাংলাদেশ হয়ে ঘুর পথে।
পরিচয় গোপন রাখা ওই সাক্ষী জানিয়েছেন, যে সমস্ত সংস্থা মারফৎ এই কাজ হয়েছে, তার সবক’টিরই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল শঙ্করের হাতে। এর মধ্যে ‘আঢ্য ফোরেক্স প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের একটি সংস্থায় এক লপ্তে ২,৭০০ কোটি টাকার নগদ অর্থকে বিদেশি মুদ্রায় বদলে দেওয়া হয়েছে।
ফলে আপাতত দেখার সোমবারের তল্লাশি অভিযানে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় ছাড়া আর কোনও প্রভাবশালীর নাম প্রকাশ্যে আসে কি না। কারণ, সে ক্ষেত্রে দুর্নীতির তদন্তের আবার নতুন একটি দিশা খুলে যেতে পারে।
রেশন দুর্নীতি নিয়ে ইডি-র তদন্ত:
সন্দেশখালিকাণ্ডের ১০ দিন পর, ফের রেশন দুর্নীতিকাণ্ডে ইডি-র অভিযান। কলকাতার চারটি জায়গায় একযোগে চলছে তল্লাশি। কলকাতার চৌরঙ্গিতে শঙ্কর আঢ্যর অফিস, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতা শঙ্কর আঢ্যর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অরবিন্দ সিংয়ের অফিসে হানা দিয়েছেন ইডি-র আধিকারিকরা। কলিন্স স্ট্রিটের ফোরেক্স অফিসেও হানা ইডি-র। কেন্দ্রীয় এজেন্সির দাবি, শঙ্কর আঢ্যর ফোরেক্স কোম্পানির মাধ্যমে রেশন দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। কালো টাকাও সাদা করা হয়েছে শঙ্করের কোম্পানির মাধ্যমে। ED-র দাবি, কীভাবে টাকা লেনদেন হয়েছে, তা জানতেই এদিন তৃণমূল নেতার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের অফিসে তল্লাশি চলছে।
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নামে বাজার থেকে টাকা তুলেছিলেন তাঁর পিএ অভিজিৎ দাস। তদন্তে নাকি এমনটাই জানা গিয়েছে বলে দাবি ইডি সূত্রে। কোথা থেকে টাকা এসেছে, কাদের কাছ থেকে এসেছে, কীভাবে টাকা তোলা হতো এবং কত পরিমাণে সবটাই নাকি এই ডায়েরির মাধ্যমে জানা গিয়েছে। কিন্তু চার্টার্ড অ্যাকাউন্টের অফিসে কেন? সূত্রের দাবি, সেই তথ্য অনুযায়ী নথিপত্রের খোঁজ পেতেই এদিন তল্লাশি চলছে বলে সূত্রের খবর।
আদালতে যে নথি পেশ করেছিল ইডি সেখানে ২০০০০ কোটি টাকার হিসেব ছিল। যা প্রায় একশোটি ফরেক্স সংস্থার মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি। তার মধ্যে ৯-১০ হাজার কোটি টাকা এই রেশন বণ্টনের দুর্নীতির টাকা, ২০০০ কোটি টাকা দুবাই পাঠানো হয়েছে। এই হিসেব খুঁজতে খুঁজতে ইডি জানতে পারে সল্টলেকে সিডকো গ্লোবাল টাওয়ারে অরবিন্দ সিংহ নামে এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টের অফিসের ঠিকানা। দিনের পর দিন দুর্নীতির টাকা যে তছরুপ করা হয়েছে তার সূত্র ধরেই এই তদন্ত চলছে। কোনও শেল সংস্থা খোলা হয়েছিল কিনা সেটাই খোঁজা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত,রেশন দুর্নীতির তদন্তে নেমে এর আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। লাগাতর তদন্তের মধ্যে দিয়ে বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্যকেও গ্রেফতার করা হয়। তবে এখনও কোনও খোঁজ নেই সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের। তাঁর বাড়িতে তদন্তের কাজে গিয়ে হামলার মুখে পড়তে হয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আধিকারিকদের। আহত হন ৩ ইডি আধিকারিক। মাথাও ফেটে যায় এক ইডি কর্তার। গোটা বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। এক্ষেত্রে শঙ্কর আঢ্যর সঙ্গে শেখ শাহজাহানের যোগাযোগ কেমন ছিল, সেই দিকটিও খতিয়ে দেখছেন ইডির তদন্তকারীরা।