কল্যাণ চক্রবর্তী
অনন্ত ভালোবাসা না থাকলে কি ‘মা’ হওয়া যায়? যিনি সত্যিকারের মা, তার সকল সন্তানের জন্যই মন কাঁদে। আপন সন্তান, অন্যের সন্তান — সবার জন্যই তিনি ভাবেন। যিনি বিশ্বমাতা, তাঁর তো পুরো জীবজগতই সন্তান। মা সারদার কথা আমরা জানি — একজন সত্যিকারের মা, পাতানো মা নন। তিনি সৎ-এর মা, অসৎ-এরও মা। তিনি শরতের মা, আমজাদেরও মা। তিনি জগজ্জননী! তাই তিনি পশুপাখিরও মা। মা সারদার স্নেহ-আদর থেকে বঞ্চিত হয় নি মনুষ্যেতর প্রাণীরাও। এমনই স্নেহময়ী!
মায়ের এক পোষা চন্দনা ছিল। তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ‘গঙ্গারাম’। এতই আদর দিয়েছিলেন, এতই যত্ন করতেন, পানটুকুও চিবিয়ে দিতে হত। নইলে ‘মা’, ‘মা’ বলে সমানে ডেকে চলতো ওইটুকু পাখি, বাড়ি মাথায় করতো। সারদা মা-কে তখন জিভে করে পান খাওয়াতে যেতে হতো পাখিটিকে।
ভক্তকূলের অহর্নিশ ডাকে গঙ্গারাম ‘মা’ বলতে শিখেছিল। সারদা দেবী তাকে পড়াতেন ‘রামকৃষ্ণ-রাম, রাম’। সে কতই না বুলি! মা এ ঘর থেকে ও ঘরে বেরিয়েছেন কী গঙ্গারাম ডেকে উঠতো। পূজা সেরে বেরিয়েছেন, তো তখনও ডাক। পূজার প্রসাদি ফলমিষ্টিটুকুর আশায় ডেকে উঠতো সে। মা সারদা তার জন্য নানান খাবার রাখতেন, যেমন ছোলা সেদ্ধ, ফল ইত্যাদি।
কিছু ভক্ত তো রীতিমতো ঈর্ষা করতো পাখিটিকে। আদিখ্যেতা! সবটুকু তুই নিবি, মায়ের মনোযোগ! আমরা কেউ নই! কেউ আফসোস করে বলে উঠতেন, “আহা! যদি গঙ্গারাম হয়ে জন্মাতে পারতাম, তো বেশ হতো!” মা নিয়মিত যত্ন করতেন এই বিহঙ্গ-সুন্দরকে। তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারতেন না। তাকে ভরপেট রেখে তবেই অন্য কাজে রত হতেন মা সারদা।
শুধুই কী পাখি! এক দুষ্ট বেড়াল, এক বাছুরের ডাকে মায়ের প্রাণ আকুল হত। ছুটে যেতেন বাছুরেরও ‘হাম্বা’ ডাক শুনে। বন্ধন হীন করে তাকে চারণে মুক্তি দিতেন। আর বেড়ালটি মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লে সে দেখার মতো ব্যাপার হতো। কেউ কখনও এসব মনুষ্যেতর প্রাণীকে শাস্তি দিতে পারতেন না। এক মহিলাকে বিড়ালের মাথায় পা দিয়ে আদর করতে দেখে মা বলে উঠলেন, “ও কি করছ? মাথায় যে ব্রহ্মের স্থান। ওইভাবে কারুর মাথায় পা দিতে নেই। প্রণাম করো।” জয়রামবাটিতে এক ত্যাগী সন্তান জ্ঞান মহারাজ বিড়ালের দুষ্কর্মের শাস্তি দিতে তুলে আছাড়া মারতেন। যাতে নির্যাতন না হয়, একবার কলকাতা যাবার আগে মহারাজকে বললেন বেড়ালের জন্য খাবার বরাদ্দ রাখতে, “দেখ জ্ঞান, বেড়ালগুলোকে মেরো না। ওদের ভেতরেও তো আমি আছি।” অবশেষে টনক নড়লো মহারাজের। নির্যাতন তো বন্ধ হলই, ছোটোমাছের বন্দোবস্তও হল। মা সারদা এইভাবে পশুপাখিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। সবার সত্যিকারের মা ছিলেন তিনি।
চন্দনা এক প্রজাতির টিয়া পাখি, ইংরেজি নাম Alexandrine Parakeet, বিজ্ঞানসম্মত নাম Psittacula eupatria. পাখিটি পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র ভারতে, বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় লভ্য। আলেকজান্ডারের প্রিয় পাখি ছিল। ভারতীয় এই পাখিটিকে তিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচে জনপ্রিয় করেন বলে জানা যায়।
প্রস্তুত পোস্টের সঙ্গে ছবিটি এঁকেছেন “দেশের মাটি হিন্দু শিল্পসুষমা গ্রুপ”-এর শ্রী শীর্ষ আচার্য। চন্দনা পাখির ছবি নেট থেকে সংগৃহীত। [ তথ্যসূত্রঃ জননী শ্রীসারদাদেবী, স্বামী অপূর্বানন্দ, উদ্বোধন, কলকাতা, ২৪ তম পুনর্মুদ্রণ, ১৪২০, পৃষ্ঠা ১৬১-৬২]