Sandhya Mukhopadhyay: কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে! সঙ্গীত জগতে সন্ধ্যা নামল, চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা

0
944

গানের জগতে তাঁর পরিধি ছিল বিশাল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লোকগান, খেয়াল, ঠুংরি, আধুনিক গান সবেতেই তিনি মুগ্ধ করেছিলেন সেই সময়ের বাঙালি শ্রোতাকে।

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ আধুনিক থেকে ছায়াছবি গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।বাংলা গানের জগতেও সন্ধ্যা নামল। চলে গেলেন কিংবদন্তি গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়৷ দূর থেকে ভেসে আসলেও, তাঁর গান শুনেই বোঝা যায় এই কণ্ঠের অধিকারীনী কে। কণ্ঠের জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চিরকালই ব্যতিক্রমী থেকেছেন। 

১৯৩১ সালে ৪ অক্টোবর কলকাতায় নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও হেমপ্রভা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নেন তিনি। তাঁর সঙ্গীত জীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হাত ধরে। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানকে গুরু হিসেবে মানতেন তিনি। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর অধীনে দীর্ঘদিন সঙ্গীতচর্চা করেছিলেন তিনি।

এরপরেই ১৯৫০ সালে মুম্বইতে পাড়ি দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দুই বছরের মধ্যে মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে আধুনিক গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ সাড়া ফেলেছিল দেশে। তবে বেশিদিন সেখানে পড়ে থাকেননি। ১৯৫২ সালে ফের কলকাতায় ফিরে আসেন গায়িকা। ১৯৬৬ সালে বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 

মুম্বই থেকে ফিরেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একের পর এক হিট গানের মাধ্যমে আপামর বাঙালির মন জয় শুরু তাঁর। বিশেষত মহানায়ক উত্তর কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমায় নেপথ্য গায়িকা হিসেবে তাঁকেই বেছে নিতেন সঙ্গীত পরিচালকরা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক জুটি। ১৯৭১ সালে ‘জয় জয়ন্তী’ এবং ‘নিশিপদ্ম’ ছবির গানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 

তবে শুধু সঙ্গীত জগতেই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন তোলপাড় গোটা বাংলাদেশ, সেই সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণের স্বার্থে এপার বাংলায় পা রাখেন। সেই মানুষদের পাশে দাঁড়াতে আরও অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

সেই সময় একাধিক দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের নেপথ্যে কণ্ঠ ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি উপলক্ষে গেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে প্রথম বিদেশি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 

বাংলা খেয়াল থেকে শুরু করে পশ্চিমী সঙ্গীতের আদলে তৈরি গান, সবই যেন তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে অবলীলায় মিলে যেত। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ায়ের পরিবারই তাঁর গানের উৎসস্থল। তাঁর পূর্বপুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত গায়ক ছিলেন। তাঁর ছেলে সারদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও একই পথে হাঁটেন। সারদাপ্রসাদের নাতি নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও গানের চর্চা করতেন।

নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বিয়ে করেন হেমপ্রভা দেবীকে। তিনিও টপ্পা গাইতেন। ১৯৩১ সালে তাঁদের কোলেই জন্ম নেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । ফলে ছোট থেকেই গানের আবহে বড় হওয়া গীতশ্রীর। কিশোর বয়সেই এইচএমভি থেকে রেকর্ড বের হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। বাঙালি শ্রোতার মুগ্ধতা শুরু সেই থেকেই। চলচ্চিত্র জগতে প্লেব্যাকের সুযোগও এলো তার পর পরই। প্রথম ছবি সমাপিকা। সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়।

সেই যাত্রায় এর পরে এলো সুচিত্রা সেনের লিপে গান গাওয়ার সুযোগ। অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে গানে মোর ইন্দ্রধনু গেয়ে ইতিহাস তৈরির শুরু গীতশ্রী। স্বর্ণযুগের গানের মধ্যে এই গান চিরতরে জায়গা করে নিল। সুচিত্রা সেনের লিপে তাঁর কণ্ঠ মিলেমিশে একাকার হল। এই জুটিও ইতিহাস তৈরি করেছিল তখনই।

গানের জগতে তাঁর পরিধি ছিল বিরাট। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লোকগান, খেয়াল, ঠুংরি, আধুনিক গান সবেতেই তিনি মুগ্ধ করেছিলেন সেই সময়ের বাঙালি শ্রোতাকে। তাঁর কণ্ঠের পরিধিও ছিল বিরাট। একেবারে খাদের নোট থেকে চড়া নোট, সবটাই যেন সহজ সরল এক অভ্যেস ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি ছিলেন বড়ে গুলাম আলি খাঁ এর ছাত্রী। তাই উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সুরও সেতু বাঁধত তাঁর কণ্ঠে সহজেই। গান যে ধরনেরই হোক, তাঁর স্বকীয়তা থাকত। আবেগ মাধুর্যে ভরা কণ্ঠ শুনেই তাই বলে দেওয়া যায় এই গান গীতশ্রীর।

১) গানে মোর ইন্দ্রধনু- অগ্নিপরীক্ষা ছবির এই গানের পরিচালক ছিলেন অনুপম ঘটক।

২) মধু মালতী ডাকে আয়- হারজিৎ ছবির জন্য এই গান গেয়েছিলেন গীতশ্রী। সুর দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। কথা প্রণব রায়ের।

৩) এ শুধু গানের দিন – পথে হল দেরি ছবিতে সুচিত্রা সেনের লিপে গাওয়া এই গান কালজয়ী। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও রবীন চট্টোপাধ্য়ায়ের সুর।

৪) তুমি না হয় রহিতে কাছে – এই গানটিও পথে হল দেরি ছবির।

৫) ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা- সবার উপরে ছবিতে এই গান গেয়েছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ায়ের সুর।

এছাড়া আরও অসংখ্য কালজয়ী গান আছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যা বাঙালির কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে চিরকাল।

সঙ্গীত জগতে এই দীর্ঘ পথচলার পর ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সর্বোচ্চ সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’-এ ভূষিত করেন ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। এক দশক পেরিয়ে ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব রাখে। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

Previous articleসন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান, শোকের ছায়া নেমেছে সঙ্গীত জগতে
Next articleBappi Lahiri: ‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পি লাহিড়ীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ অনুরাগীরা, শোকপ্রকাশ মোদী-মমতারও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here