দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া। ৭৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। সোমবার অর্থাৎ ৮ মে মিলল সন্ধ্যায় সামনে আসে এই খবর। বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন লেখক। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে বিকেল ৫ টা ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। খবর সামনে আসা মাত্রই শোকের ছায়ায় ডোবে সাহিত্যমহল।

বাংলা সাহিত্যে এ যেন অকালবেলা। চলে গেলেন অনিমেষ, মাধবীলতার স্রষ্টা । চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম এক শিল্পী। ‘সাতকাহন’ থেকে ‘গর্ভধারিনী’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, অর্জুন, মেজরের অ্যাডভেঞ্চার সহ বাংলা সাহিত্যের একের পর এক ক্লাসিক সৃষ্টির রূপকার চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে।

নিজের বড়ো দাদার মতো ছিলেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর প্রয়াণে ভেঙে পড়েছেন ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। জানালেন, ‘আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন কতকিছু। একসঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে, বিদেশে গিয়েছি। উনি আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, আমার সব আবদার শুনতেন। আমার লেখা পড়ে কতবার বলেছেন ভালো হয়েছে। লেখা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষটাকে বাইরে দেখলে রুক্ষ মনে হলেও, আপাদমস্তক স্নেহ দিয়ে ঘেরা একটা মানুষ। সুনীল দা গেছেন আগেই, সমরেশদাও চলে গেলেন আজ। সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে শোকের ছায়া সাহিত্য জগতে।

খবরের পাতায় প্রায়ই উঠে আসে উত্তরবঙ্গের বঞ্চনার কথা। অথচ বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গকে অন্য আলোকে তুলে ধরার সর্বশ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী বোধ করি তিনিই। জন্ম ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে। তখনও পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যার ছাপ খানিক পড়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলেও।

এই উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সেই কেটেছে সমরেশ মজুমদারের ছাত্রজীবন। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের অনন্য সৌন্দর্য। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়েছেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন স্কটিশচার্চ কলেজে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে স্নাতকোত্তরে পড়েন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট প্রাঙ্গণে। যেখানে ছাত্রজীবন কাটে তাঁর অনিমেষেরও।

লেখালেখির জগতেও প্রবেশ বাংলার একটি বিখ্যাত পত্রিকার হাত ধরে। প্রথম লেখা প্রকাশ ওখানেই। পরে কর্মসূত্রেও জড়িয়ে ছিলেন বাংলার একটি প্রথমসারির পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে। তবে সমরেশ মজুমদারকে একধাক্কায় খ্যাতির আলোয় নিয়ে আসে তাঁর বিখ্যাত ‘ট্রিলজি’। ‘উত্তরাধিকার’ যার প্রথম খণ্ড। পরের খণ্ড ‘কালবেলা’ আজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ‘ক্লাসিক’ বলে স্বীকৃত। কলকাতার উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা স্লোগান, বিপ্লব, রক্ত, বোমা ও প্রেমের এক তোলপাড় ফেলা কাহিনীর জন্য ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে।

বিপ্লব, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও তিনি ছেড়ে যাননি। তাঁর ‘গর্ভধারিনী’ উপন্যাস কার্যত বৈপ্লবিক। সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের। গোয়েন্দা-গল্পেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখা অর্জুনের গল্পে বিভোর থেকেছে আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীর পাঠকরা।

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কম নেই। ফেলুদা, কাকাবাবু, ব্যোমকেশ সকলেই স্বকীয়ভাবে বিরাজ করছেন আজও। কিন্তু সবাই কলকাতায় থাকেন। রহস্য ধরতে হিল্লিদিল্লি যান। সেখানে সমরেশের গল্পের গোয়েন্দা, তথা, সত্যসন্ধানী অর্জুন জলপাইগুড়ির ছেলে। কলকাতাতেও কেস সলভ করতে এসে এসেছে। কিন্তু তার আসল জায়গা জলপাইগুড়ি।

মফঃস্বল শহর, তার মানুষ, জলপাইগুড়ির আশেপাশে তিস্তা, তোর্সা, করলা ইত্যাদি নদী ছাড়িয়ে জলদাপাড়া,মাদারিহাট, বীরপাড়া, মালবাজার, রাজাভাতখাওয়া, হলং, গরুমারা ইত্যাদি ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলে আর চা বাগানে ঘেরা এক প্রাকৃতিক পরিবেশে গজিয়ে ওঠে নানা ভয়ানক রহস্য। ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ ইত্যাদি গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে অর্জুন। তার লাল মোটরবাইক কার্যত এক ‘আইকনিক’ অংশ হয়ে ওঠে গল্পের। সমরেশ অর্জুনকে বাংলাতেই আটকে রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকাতে, অর্জুন কেস ধরেছে একেবারে নিউ ইয়র্ক সিটিতে।

উত্তরবঙ্গের সমস্ত সৌন্দর্য, আবেগ, রহস্য ধরা দিত তাঁর কলমে। কলকাতাবাসী বহু পাঠক তাঁর লেখাতেই চিনেছিল জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা, রূপমায়া সিনেমা, হাকিমপাড়া, শিল্পসমিতিপাড়া, রায়কতপাড়া। দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কাছে হার মেনে অবশেষে উত্তরের আকাশে জ্বলজ্বল করা এক তারার দেশেই চলে গেলেন সমরেশ মজুমদার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here