ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়– রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশন হচ্ছে পাশাপাশি অবস্থানরত জোড়া-প্রতিষ্ঠান। একে অন্যের পরিপূরক এবং দুইয়ে মিলে এক অখণ্ডের সংসার। রামকৃষ্ণ মিশনের জন্মলগ্ন ১ লা মে, ১৮৯৭, স্বামীজির উপস্থিতিতে। সূত্রপাতে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বা ‘রামকৃষ্ণ প্রচার’-এর নাম ছিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন এসোসিয়েশন’। কলকাতার বাগবাজার এলাকায় ঠাকুরের ভক্ত বলরাম বসুর গৃহে এই এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তবে রামকৃষ্ণ মঠ বা সন্ন্যাসী সঙ্ঘের আদি কাজ কিন্তু তার বহু আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই মঠ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় কাশীপুর বাগানবাড়িতে দানা বাঁধে। হয়তো মঠের নাম ঠিক হয় নি, হয়তো ঠিকানাও নির্দিষ্ট ছিল না, হয়তো নানান সময়ে মঠ স্থানান্তরিত হয়ে নানান জায়গায় গিয়েছে, তবুও তার একটি প্রবল প্রবাহ অব্যাহত ছিল। কাশীপুর পর্বে ঠাকুরের শরীর যাবার পর বরানগরের পোড়ো বাড়িতে ১৮৮৬ সালের ১৯ শে অক্টোবর থেকে মঠের কাজ এগিয়ে চলল। মঠজীবনে বরানগরে ছিল কঠোর তপশ্চর্যার ক্ষেত্র এবং তা ছিল অনস্বীকার্য, এমনই মন্তব্য করেছিলেন স্বামীজি।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবপ্লাবনের পটভূমিতেই ছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠার মালঞ্চ ও তার বীজ। কথামৃতে দেখা যায় এই বাগানের জন্য আদরের নরেনকে দলপতি নির্বাচিত করে গেছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ১৮৮৪ সালের ২৩ শে মার্চ বললেন, নরেন “দলপতি টলপতি হয়ে যেতে পারে।” আরও বললেন, “ও যেদিকে যাবে, সেইদিকেই একটা কিছু বড় হয়ে দাঁড়াবে।”
নরেন নিজেও জানতেন ঠাকুরের নির্দেশ তাঁর প্রতি ছিল। প্রমদাদাস মিত্রকে লেখা চিঠিতে তার আভাষ নিজেই দিয়েছেন, “আমার উপর তাঁহার নির্দেশ এই যে, তাঁহার দ্বারা স্থাপিত এই ত্যাগীমণ্ডলীর দাসত্ব আমি করিব,…তাঁহার আদেশ এই যে, তাঁহার ত্যাগী সেবকমণ্ডলী যেন একত্রিত থাকে এবং তজ্জন্য আমি ভারপ্রাপ্ত।”
স্বামীজির শিষ্য শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী রচিত ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ গ্রন্থের পূর্ব কাণ্ডে সপ্তম বল্লীতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বিবৃত রয়েছে।
মিশনের উদ্দেশ্য: মানবের হিতার্থ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ যে-সকল তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং কার্যে তাঁহার জীবনে প্রতিপাদিত হইয়াছে, তাহার প্রচার এবং মানুষের দৈহিক, মানসিক ও পারমার্থিক উন্নতিকল্পে যাহাতে সেই সকল তত্ত্ব প্রযুক্ত হইতে পারে, তদ্বিষয়ে সাহায্য করা এই ‘প্রচারের’ (মিশনের) উদ্দেশ্য।
মিশনের ব্রত: জগতের যাবতীয় ধর্মমতকে এক অক্ষয় সনাতন ধর্মের রূপান্তরমাত্র জ্ঞানে সকল ধর্মাবলম্বীদিগের মধ্যে আত্মীয়তা-স্থাপনের জন্য শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ যে কার্যের অবতারণা করিয়াছিলেন, তাহার পরিচালনাই এই ‘প্রচারের’ (মিশনের) ব্রত।
মিশনের কার্যপ্রণালী: মানুষের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বিদ্যাদানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিতকরণ, শিল্প ও শ্রমোপজীবিকার উৎসাহবর্ধন এবং বেদান্ত ও অন্যান্য ধর্মভাব রামকৃষ্ণজীবনে যেরূপে ব্যাখ্যাত হইয়াছিল, তাহা জনসমাজে প্রবর্তন।
ভারতবর্ষীয় কার্য: ভারতবর্ষের নগরে নগরে আচার্যব্রত-গ্রহণাভিলাষী গৃহস্থ বা সন্ন্যাসীদিগের শিক্ষার আশ্রমস্থাপন এবং যাহাতে তাঁহারা দেশদেশান্তরে গিয়া জনগণকে শিক্ষিত করিতে পারেন, তাহার উপায়-অবলম্বন।
বিদেশীয় কার্যবিভাগ: ভারতবহির্ভূত প্রদেশসমূহে ‘ব্রতধারী’-প্রেরণ এবং তত্তৎদেশে স্থাপিত আশ্রমসকলের সহিত ভারতীয় আশ্রমসকলের ঘনিষ্ঠতা ও সহানুভূতিবর্ধন এবং নূতন নূতন আশ্রমসংস্থাপন।
শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতিতে ষোলো-সতের জন তাপসকে নিয়ে রামকৃষ্ণ সন্ন্যাসী সঙ্ঘের সূচনা কাশীপুর বাগানবাড়িতে। এটিই ছিল রামকৃষ্ণ ভাব-আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। এখানেই এগারোজন ত্যাগীভক্তকে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে গেরুয়া বস্ত্র দান করেন। নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, বাবুরাম, নিরঞ্জন, যোগীন্দ্র, তারক, শরৎ, শশী, কালী, লাটু এবং বুড়োগোপাল পেলেন গেরুয়া সন্ন্যাস। আর এই মঠেই ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি তিনি ‘কল্পতরু’ হলেন। এই মঠেই গুরুভ্রাতাদের প্রতীতি জন্মাল, সারদাদেবী শ্রীরামকৃষ্ণের ‘শক্তি’, তিনি জীবন-মিশনের সহায়িকা সঙ্ঘজননী। এখানেই ঠাকুরের জন্য সংসারত্যাগ করে আসা যুবকদের সঙ্গবদ্ধ করলেন নরেন্দ্রনাথ। কেননা এইকাজে নরেনের মধ্যে যথাসর্বস্ব শক্তি সঞ্চার করে দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
১৮৮৬ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারী শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে হাতে লিখে দিলেন, “নরেন শিক্ষে দিবে, যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে।” কাশীপুর বাগানবাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি-সুখ আস্বাদন করেছিলেন ঠাকুরের আশীর্বাদে। এখানেই ঠাকুরের কাছ থেকে তিনি সংগঠন তৈরির উপদেশ পেলেন এবং ঠাকুর কর্তৃক নেতার ভূমিকায় সংস্থাপিত হলেন, “দ্যাখ নরেন, তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি। কারণ, তুই সব চেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। এদের খুব ভালবাসবি। আর ঘরে ফিরে না গিয়ে সবাই যাতে একসঙ্গে খুব সাধন ভজনে মন দেয় তার ব্যবস্থা করবি।” রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মূলমন্ত্র হচ্ছে, “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ”, নিজের মোক্ষ লাভের জন্যই জগতের জন্য সেবাকাজ করতে হবে। সঙ্ঘের আদর্শ ছিল অভিনব। প্রবর্তিত হল সংগঠিত সেবাকাজ। এই সেবাব্রতকে বৃহত্তর সমাজ ক্রমে স্বাগত জানাতে থাকল। শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ হয়ে উঠল সাধনজীবনের অঙ্গ। দেখা যাচ্ছে রামকৃষ্ণ ভাবধারার উৎপত্তি দক্ষিণেশ্বরে মাতৃমন্দির ও পঞ্চবটীতে হয়ে তা ধীরে ধীরে শ্যামপুকুর, কাশীপুর, বরানগর, আলমবাজার পেরিয়ে পৌঁছাল বেলুড়ে। গঙ্গার তৈরি হল রামকৃষ্ণ-ভাবগঙ্গার প্রবল প্রবাহ।
কাশীপুর মঠ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ব্রহ্মানন্দ মহারাজকে চিঠিতে লিখছেন (১৩ ই জুলাই, ১৮৯৭), “ও-বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ।” অর্থাৎ কাশীপুরে ভাড়া করা বাগানবাড়িতেই প্রথম গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ মঠ, যা কলকাতায় মতিঝিলের কাছে কাশীপুর রোডের উপর ১১ বিঘা ৪ কাঠা জমির উপর বিস্তৃত ছিল। এটি শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অন্ত্যলীলার স্থল’ এবং এখানেই মহাপ্রয়াণের পূর্বে তিনি একাদিক্রমে ২৪৮ দিন অবস্থান করেছেন (১১ ই ডিসেম্বর, ১৮৮৫ — ১৬ ই আগষ্ট, ১৮৮৬)। পরে ১৯০১ সালে একটি ট্রাস্ট হিসাবে রামকৃষ্ণ মঠ রেজিস্ট্রিকৃত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই এই মঠ রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
এদিকে ১ লা মে, ১৮৯৭ তে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি রবিবার বিকেল চারটের পর বলরাম বসুর বাড়িতে সাপ্তাহিক অধিবেশন হত৷ একাদিক্রমে তিন বছর ধরে সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বামীজি সুবিধামত ওই অধিবেশনগুলিতে উপস্থিত থাকতেন, উপদেশ দিতেন, কখনও সঙ্গীত পরিবেশনও করতেন।
দেখা যায় ২ রা জানুয়ারি, ১৮৯৯ সালে হাওড়ার বেলুড়ে সংগঠনের নিজস্ব জমি ও বাড়িতে রামকৃষ্ণ ভাবধারার মূলকেন্দ্র স্থাপিত হল। জানা যায় এই স্থানটিতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব পূর্বেই পদার্পণ করেছিলেন। যেন মিশন তৈরির জন্য ‘কুটোবাঁধা’ হয়েই ছিল এই জমি। স্বামী বিবেকানন্দ মঠের জন্য জমিটি কিনেছিলেন ১৮৯৮ সালের ৪ ঠা মার্চ ভাগবতনারায়ণ সিং-এর মালিকানা থেকে। তারও পূর্বে এই জমিটি ছিল নেপালরাজের কাঠগোলা, যেখানে ঠাকুরের ভক্ত, ‘কাপ্তেন’ বিশ্বনাথ উপাধ্যায় উকিল হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন এবং এই কাঠগোলাটি ঠাকুরকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। বেলুড়ে গঙ্গার ধারে অসমতল জমিটি কেনার পর তদারকি জন্য যে সময় লেগেছিল, তখন নিকটস্থ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে চলেছিল মঠের অস্থায়ী কাজ৷ অবশেষে ১৮৯৮ সালের ৯ ই ডিসেম্বর মঠের নিজস্ব জমিতে ঠাকুরকে পুজো করে পরমান্ন নিবেদন করেছিলেন৷ স্বামীজির প্রয়াণের বহু পরে ৪ ঠা মে, ১৯০৯ সালে ‘The Registration of Societies Act XXI of 1860’ অনুযায়ী রামকৃষ্ণ মিশনের রেজিস্ট্রেশন হয়।
রামকৃষ্ণ মিশন এসোসিয়েশনের সমিতির সাধারণ সভাপতি হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ নিজে, কলকাতা-কেন্দ্রের সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দ, কলকাতার সহ-সভাপতি হলেন স্বামী যোগানন্দ, সেক্রেটারি এটর্নী নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সহকারী সেক্রেটারি হলেন ডাক্তার শশিভূষণ ঘোষ এবং শরচ্চন্দ্র সরকার এবং শাস্ত্রপাঠক হলেন শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী।
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কাজ সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতা লিখছেন (‘স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি’ গ্রন্থ থেকে), পীড়িতের শুশ্রূষা ও দরিদ্রকে আহার্যদান বস্তুতঃ প্রথম হইতেই শ্রীরামকৃষ্ণ-সন্তানগণের স্বাভাবিক কার্য ছিল৷ কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার পরে ঐ কার্যগুলি বিপুল আকার ধারণ করে। অতঃপর ঐ-সব কার্য জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হইত। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সাহায্য দিবার জন্য, কোনো শহরে স্বাস্থ্যবিধি পালন সম্বন্ধে নির্দেশ দিবার জন্য, অথবা কোনো তীর্থস্থানে পীড়িত ও মুমূর্ষুগণকে সেবা-শুশ্রূষা করিবার জন্য মঠ হইতে লোক পাঠানো হইতে লাগিল। একজন মুর্শিদাবাদে একটি অনাথাশ্রম ও শিল্প বিদ্যালয় খোলেন; অপর একজন দাক্ষিণাত্যে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি আরও লিখেছেন, স্বামীজির মতে এই কাজগুলি যারা করেন, তারা হলেন Sappers and miners অর্থাৎ ধর্মবাহিনীর জঙ্গল-সাফ-করা ও রাস্তা-তৈয়ার-করার দল। অর্থাৎ স্বামিজীর পরিকল্পনা ছিল এর চেয়েও ব্যাপকতর। সমগ্র দেশে শিল্পশিক্ষা-বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা এবং নারীশিক্ষা বিধানই ছিল উদ্দেশ্য।
বরানগরে মঠ চলাকালীন সময়ে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাবুরাম মহারাজের মায়ের আমন্ত্রণে নয়জন গুরুভাই (নরেন্দ্র, তারক, শশী, কালী, বাবুরাম, শরৎ, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর ও সারদা) হুগলির আঁটপুরে পৌঁছালেন। এখানেই ২৪ শে ডিসেম্বরে তাঁরা ধুনি প্রজ্জ্বলিত করে পালন করলেন ‘ত্যাগব্রত দিবস’। ১৮৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে নরেন্দ্রনাথ এই বরানগর মঠ থেকে বেরিয়ে এলেন ভারতবর্ষকে পরিপূর্ণভাবে চিনতে। তারপর তিনি পৌঁছালেন শিকাগো ধর্মমহাসভায়৷ সাত বছর পর যখন মঠে ফিরে এলেন (তখন মঠ আলমবাজারে) তখন তিনি বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।
১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঠাকুরের জন্মতিথির পূর্বে আলমবাজারে মঠের স্থানান্তর ঘটে৷ ঠিকানা হয় রামচন্দ্র বাগচি লেন, ডাকঘর বরানগর, বর্তমান ডাকঘর আলমবাজার৷ দুই বিঘে, পাঁচ কাঠা, সাত ছটাক, বাইশ বর্গফুট জমির উপর ছিল আলমবাজার মঠের ভগ্ন বাড়ি, পুকুর, কুয়ো, ফলের বাগান। ১৮৯৭ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্তও মঠের নাম নির্বাচিত হয় নি, এমনকি সুনির্দিষ্ট ঠিকানাও ছিল না। মঠবাসীর ডাক-যোগাযোগের ঠিকানা ছিল বলরাম বসুর প্রয়াণের আগে পর্যন্ত বাগবাজারের বাড়িটি৷
আলমবাজারে মঠের কাজ চলে প্রায় ছয় বছর, শেষ হয় ১৮৯৮ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। এই কালখণ্ডে মঠনিবাসীগণ এক মহান উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন৷ এই সময়ের মধ্যেই স্বামীজির বিশ্বজয়, সেই অসাধারণ সাফল্যের সংবাদ পৌঁছে গেল মঠজীবনের শান্ত-সমাহিত জীবনে, তৈরি হল এক অভূতপূর্ব আনন্দ এবং স্পন্দন।
শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখনী থেকে জানা যায়, আলমবাজার মঠে চাকর, বামুন কেউ ছিলেন না। শশী মহারাজ ঠাকুরের ভোগ রান্না করতেন, কানাই মহারাজ হাটবাজার করতেন এবং বাসন মাজতেন, যোগীন মহারাজ, হরি মহারাজ, সুশীল মহারাজ প্রমুখ ঘর ঝাঁট দিতেন, কুটনো কুটতেন, মসলা বাটতেন ইত্যাদি।
আলমবাজার মঠ সম্পর্কে (১৮৯৫ সালের ঘটনা) স্বামী অখণ্ডানন্দজী লিখেছেন, “মঠে আমরা প্রায় ডাল, ভাত ও চচ্চড়ি মাত্র খাইতাম। কোন কোন দিন ডালের সঙ্গে ফালা করে ঝুনো নারিকেল আমাদের তরকারির সাধ মিটাইত৷ রাত্রে রুটিতে ঘৃতের সংস্পর্শও থাকিত না।” তবে প্রবজ্যা থেকে ফিরে অখণ্ডানন্দজী দেখলেন, মঠের আর্থিক অবস্থায় স্বচ্ছলতা৷ কারণ ভক্তমণ্ডলী তখন ক্ষমতা অনুযায়ী খাবার মঠে আনতেন৷ নূতন সতরঞ্চি এল, পড়ার চৌকি আর আলো এল, পড়বার কাপড় ও চাদরের সংস্থান হল। অখণ্ডানন্দের ভাষায়, “আলমবাজার মঠে মা-লক্ষ্মী যেন ক্রমে ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়াছিলেন।”
১৮৯৭ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী স্বামীজি আলমবাজার মঠে ফিরলেন। এরপর গঙ্গার পূর্বকূল ছেড়ে মঠ উঠে এল পশ্চিম কূলে বেলুড়ে৷ এই এক বছরের মধ্যে তিনি ভারতের নানান স্থান ভ্রমণ করেন এবং ৫০ দিনের মতো সময় আলমবাজারে অতিবাহিত করেন। জানা যায় ১৮৯৭ সালের মার্চের শেষার্ধে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজে গেলেন মঠ স্থাপনের জন্য। তিনি ঠাকুরের পবিত্র দেহাবশেষ সংরক্ষণ ও সেবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মঠে পূজা ও সন্ধ্যারতিও করতেন। তাঁর অবর্তমানে স্বামী প্রেমানন্দ মঠের পূজার সমস্ত দায়িত্ব নিলেন। এদিকে ১৮৯৭ সালের ১২ ই জুন আলমবাজার মঠবাড়িটি ভূমিকম্পের কারণে ফাটল দেখা গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে মঠবাড়ি বসবাসের অনুপযুক্ত হল। স্বামীজি তখন মঠের জন্য পাকাপোক্ত জমি সংগ্রহে মনোযোগ দিলেন, এমনকি ঠাকুরকে ১০৮ বিল্বপত্রে আহুতি দিলেন মনস্কামনা করে৷ অবশেষে বেলুড়ে জমি পাওয়া গেল, সেই জমির জন্য নেওয়া হল উকিল বন্ধুদের পরামর্শ। জমিটির প্রথম সন্ধান মেলে ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে৷ জমি কেনার জন্য হেনরিয়েটা মূলার ঊনচল্লিশ হাজার টাকা দান করতে রাজি হন৷ জমিটি ছিল ছোটো দুটি বাড়ি সহ বাইশ বিঘা পরিমাণের, মালিক ছিলেন পাটনা নিবাসী ভাগবৎ নারায়ণ সিং। জমি কেনার জন্য ১০০১ টাকা দিয়ে ১৮৯৮ সালের ৩ রা ফেব্রুয়ারী বায়না করা হয়৷
জমি কেনার তারিখটি ১৮৯৮ সালের ৪ ঠা মার্চ। ১৮৯৮ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারী বেলুড়ের প্রস্তাবিত জমির পাশে দক্ষিণ দিকে ৪৮, লালাবাবু সায়র রোডে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি মাসিক ৮৫ টাকায় ভাড়া নিয়ে আলমবাজার থেকে মঠ সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ফলে মঠের স্থায়ী বাড়ি নির্মাণের সময় মঠবাসীরা নিয়ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। এদিকে নীলাম্বর ভবনে ১৮৯৮ সালে মঠের কাজ চলল প্রায় সাড়ে দশমাস। ততদিন নীলাম্বর ভবনে একটি গোলপাতার ছাউনিঘরকে ঠাকুরঘর রূপে ব্যবহার করা হল। এই বেলুড়ই হয়ে উঠল সাংগঠনিক কেন্দ্র, পাশাপাশি নতুন নতুন কেন্দ্রও গড়ে উঠতে থাকল।
মঠের পরিচালনা ও কাঠামো সম্পর্কে স্বামীজির অভিমত (১৮৯৭ সালের ১১ জুলাই-এর কার্য-বিবরণী) ছিল, মঠে তিনজন করে মহন্ত নির্বাচন করলে ভালো, একজন দেখবেন বৈষয়িক, একজন আধ্যাত্মিক এবং একজন দেখবেন জ্ঞানার্জনের বিষয়। স্বামীজি সবসময় জনসাধারণের দান করা অর্থের সঠিক হিসাব রাখার উপর সবসময় জোর দিয়েছেন৷ এমনকি বিদেশে বসেও চিঠিতে তার নির্দেশ দিয়েছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে (১০ ই আগষ্ট, ১৮৯৯), “লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায় — এই দস্তুর। প্রতিপদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়।” অল্প খরচে স্থায়ী সৎকাজ করতে স্বামীজি অনুপ্রাণিত করেছেন মঠবাসীকে। এজন্য ছকও বেঁধে দিয়েছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, উভয়েরই বার্ষিক আলোচনা সভা হওয়া উচিত এমন মত পোষণ করেছিলেন। মঠ-জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হল ত্যাগ এবং তপস্যা। কারণ শ্রীমায়ের মতে, এ যুগে ঠাকুরের প্রধান বিশেষত্ব ছিল ত্যাগ। তাই ত্যাগরূপ দু’টি ডানাতে ভর করে পরম সত্যে উড্ডীন হওয়ার সাধনা মঠ জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। আদর্শ প্রচার মঠজীবনে যে একান্ত প্রয়োজনীয় তা স্বামীজি বলেছেন। কারণ প্রচারেই সম্প্রদায়ের জীবনীশক্তি অটুট থাকে, প্রচার কাজ তাই বন্ধ না করে চালিয়ে যেতে হয়৷
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রচারের অন্যতম উপায় ছিল পত্র পত্রিকা। এইভাবে প্রকাশিত হতে লাগল ইংরেজি পাক্ষিক ‘ব্রহ্মবাদিন্’ (১৮৯৫ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর মাদ্রাজ থেকে), ইংরেজি মাসিক ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ (১৮৯৬ সালের জুলাই মাদ্রাজ থেকে) এবং বাংলা ‘উদ্বোধন’ (১৮৯৯ সালের ১৪ ই জানুয়ারি কলকাতা থেকে)। রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার পর প্রতি রবিবার শাস্ত্রপাঠ ও ভাষণের আয়োজন করা হয়। পরে বড় বড় হলে এবং জনসভার আয়োজন করে বক্তব্য পরিবেশনের ব্যবস্থা হয়৷
তথ্যসূত্র:
১. শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামি-শিষ্য-সংবাদ, উদ্বোধন, কলকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৯৬০, ৩৩ তম পুনর্মুদ্রণ, ১৪২৪, পৃষ্ঠা – ৩৬-৪৩।
২. ভগিনী নিবেদিতা, স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, (অনুবাদ – স্বামী মাধবানন্দ), উদ্বোধন, কলকাতা, দ্বাদশ পুনর্মুদ্রণ ১৪০৪, পৃষ্ঠা -২৩-৫২।
৩. রামকৃষ্ণ মিশন: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, উদ্বোধন, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৪০৪, সপ্তম পুনর্মুদ্রণ ১৪২৫, পৃষ্ঠা – ১-১৪।
৪. স্বামী প্রভানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা, উদ্বোধন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৪০৮, ১১তম পুনর্মুদ্রণ ১৪২৯, পৃষ্ঠা – ১- ৩০২।
৫. স্বামী প্রভানন্দ, বলরাম-ভবন থেকে বলরাম-মন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ (বলরাম মন্দির), কলকাতা, পৃষ্ঠা – ১-৭২।