দেশের সময়: কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, দেশজুড়ে এখন একটাই আলোচনা, রামমন্দির। এটাই চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চেয়েছিলেন, পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ যাই হোক না কেন, গোটা ভারতবর্ষ আলোচনা করুক, রামমন্দির নিয়ে। তাঁর চাওয়া সার্থক হয়েছে। পথে-ঘাটে, ট্রেনে-বাসে, স্কুল-কলেজে, অফিসে এমনকী টিভি সিরিয়ালেও জায়গা করে নিয়েছে রাম। এ যেন ভাবাবেগের নতুন কোনও সমুদ্র। আর রামের প্রতি দেশবাসীর এই ভাবাবেগকে উস্কে দিতে মরিয়া বিজেপি।
তারা যেখানে যে মন্দির পাচ্ছে, সেই মন্দিরেই রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে ২২ জানুয়ারি। এই যেমন ডুয়ার্সের চা বলয়, সেখানে বিজেপি ঘোষণা করেছে, অযোধ্যায় রামমন্দিরে যখন রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে, ঠিক তখন চা বলয়ে যত মন্দির আছে, সে কালীমন্দির, শিবমন্দির, শনিমন্দির, যাই হোক, সবমন্দিরেই রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হবে!
বিষয়টি নিয়ে বিরোধীরা তোপ দাগছে। তৃণমূল বলছে, বিজেপি রামকে নিয়ে কুৎসিত রাজনীতি করছে। এসবে অবশ্য কিছু যায় আসে না গেরুয়া শিবিরের। কারণ, রায়গঞ্জের বিজেপি সাংসাদ দেবশ্রী চৌধুরী তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন, হ্যাঁ, রামকে নিয়ে রাজনীতি করছেন তাঁরা। আর এই রাজনীতি যে শুধু শুধু নয়, সেটাও বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে, এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের। তাদের বক্তব্য, প্রতিবার লোকসভা ভোটের আগে একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি করেন নরেন্দ্র মোদি। আর সেই ইস্যুতে ভর করে দিব্যি ভোট বৈতরণী পার হয়ে যান তিনি। তাঁর এবারের ইস্যু রামমন্দির। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং, রামকে নিয়ে এই যে ভাবাবেগ প্রদর্শন, ভক্তির আবহ তৈরির চেষ্টা, তাকে ভোট বাক্সে নিয়ে আসাই লক্ষ্য পদ্ম শিবিরের।
রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন শঙ্করাচার্যরা। রামমন্দির নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। কিন্তু এসবে কিছু এসে যায় না বিজেপির। বরং রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে অর্ধ-দিবস সরকারি ছুটির ঘোষণা করা হয়েছে। ছুটি দিয়েছে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ।
উত্তরপ্রদেশে রামমন্দির উদ্বোধনের দিন রাজ্যে মদ, মাছ, মাংস কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ওইদিন বন্ধ থাকবে শেয়ার বাজার। রামমন্দির উদ্বোধনের দিন এরাজ্যেও যাতে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বালুরঘাটের সাংসদ তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। রামমন্দিরে উপস্থিত না থেকেও, দেশব্যাপী মানুষ যাতে সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকতে পারেন, সেজন্য দেশের বিভিন্ন বুথ এলাকা থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের সমস্ত জেলে এই অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচার দেখানো হবে। এমনকী লাইভ দেখানো হবে যোগীরাজ্যের বিভিন্ন সিনেমা হলেও। গোটা ভারতজুড়ে ৭০টি শহরে মোট ১৬০টি প্রেক্ষাগৃহে রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাম জন্মভূমি জুড়ে সাজো সাজো রব।
দেশজুড়ে মানুষের মুখে মুখে রাম-নাম। অযোধ্যায় পৌঁছে গিয়েছে সবচেয়ে দামি রামায়ণ। রামমন্দিরের আদলে তিনতলা বাক্সে তৈরি করা হয়েছে রামায়ণের বইটি। যার মূল্য ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। ওজন ৪৫ কেজি। এমনভাবে বইটি তৈরি করা হয়েছে, ৪০০ বছরেও বইয়ের পাতা নষ্ট হবে না। যে কালি দিয়ে ওই রামায়ণ ছাপা হয়েছে, সেটি তৈরি হয়েছে জাপানে। যে বাক্সে রামায়ণটি রাখা হয়েছে, সেটি তৈরি করা হয়েছে আমেরিকার ওয়ালনাট গাছের কাঠ দিয়ে। অযোধ্যা শহর ছেয়েছে অশোক সিঙ্ঘলের কাটআউটে। তাঁর নেতৃত্বেই চলেছিল রাম জন্মভূমি আন্দোলনের মূল পর্ব।
সেই স্বীকৃতি দিতে রামমন্দির যাওয়ার মূল প্রবেশপথের নাম অশোক সিঙ্ঘল দ্বার। তারই ভিতরে জমা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রামলালার জন্য উপহার। বাংলা থেকে গিয়েছে মধু। প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে দেশের বিভিন্ন নদী, সাগর ও হ্রদের জল দিয়ে স্নান করানো হবে রামলালাকে। থাকবে ঘি, মধু ও ডাবের জল। থাকছে বিহারের ঘি। কর্ণাটকের চন্দন। কেরলের ডাব। আর বাংলার সুন্দরবনের মধু। ১০১ কেজি মধু এসেছে। নিয়ে গিয়েছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
তবে এসব ছাড়িয়ে অযোধ্যায় এখন আলোচনা ধূপকাঠি নিয়ে। সেই ধূপকাঠি আসছে প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাত থেকে। একটা ধূপকাঠি ১০৮ ফুট লম্বা। চওড়া ৩ ফুট। ৫০ কিমি দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যাবে বলে দাবি। এক মাস ধরে জ্বলবে ওই ধূপ। রামের জন্য গয়নাগাটিও কম জমা পড়ছে না। রয়েছে পাঁচ হাজার হীরে বসানো হার। আনা হয়েছে ২১০০ কেজি ওজনের ঘণ্টা। রাজস্থান থেকে এসেছে সিংহাসন। সোনায় মোড়া আট ফুটের মার্বেল পাথরের সিংহাসনে বসবেন রামলালা। সাত হাজার কেজির হালুয়া। মন্দিরের তালা এসেছে আলিগড় থেকে। সেই তালার ওজন ৪০০ কেজি। আসলে সবটাই বিশালত্ব প্রমাণের চেষ্টা। বিরোধীদের তোপ, এসবের আড়ালে মোদির ‘আমিই বড়’ প্রমাণের চেষ্টা স্পষ্ট।
রামমন্দির ঘিরে বদলে গিয়েছে অযোধ্যা। নতুন স্টেশন, বিমানবন্দর, নিউ অযোধ্যা টাউনশিপ। সব মিলিয়ে খরচ করা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।
বুধবার সন্ধ্যায় অযোধ্যায় রামমন্দিরে নিয়ে আসা হয়েছে শিশু রামের ৫১ ইঞ্চি উচ্চতার মূর্তি। বৃহস্পতিবার ১টা ২৮ মিনিটে শুভ মুহূর্তে সেটিকে গর্ভগৃহের মূল বেদিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কৃষ্ণশিলায় তৈরি রামলালার মূর্তির ছবি ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে। মূর্তির মুখাবয়ব ঢাকা রয়েছে হলুদ কাপড়ে। রামলালার গায়ে সাদা চাদর। মূর্তিটি তৈরি করেছেন কর্ণাটকের প্রখ্যাত ভাস্কর অরুণ যোগীরাজ। রামমন্দির নিয়ে রাজনৈতিকভাবে খোঁচা দিতেও ছাড়ছে না বিজেপি। শনিবার সোশ্যাল মিডিয়া এক্স হ্যান্ডেলে রাজ্য বিজেপির তরফে পোস্ট করা হয়েছে, ওই দেখ কমরেড…মন্দির ওহি বান রাহা হ্যায়!
রামমন্দিরের ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিয়েছে বলিউডও। মুম্বইয়ে রামমন্দিরের সিঁড়ি ধুয়েছেন জ্যাকি শ্রফ। রামমন্দির দর্শনের জন্য ব্যবস্থা করেছে রেল। ১৬০০ টাকা ভাড়ায় ২৯ জানুয়ারি হাওড়া স্টেশন থেকে শুরু হবে আস্থা স্পেশাল ট্রেন পরিষেবা। এদিকে, রামমন্দিরের প্রসাদ বিক্রি হচ্ছিল একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এনিয়ে কর্তৃপক্ষকে সরকারের তরফে নোটিশ ধরানো হয়েছে।
শুধু রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা নয়, অযোধ্যায় রামমন্দির চত্বরে আরও সাতটি মন্দির হচ্ছে। মহর্ষি বাল্মীকি, শবরী, নিষাদরাজ, অহল্যা, বশিষ্ঠ, বিশ্বকর্মা ও অগস্ত্য মুনির পুজো হবে। আগেই মোদি দাবি করেছেন, রাম তাঁর ১৪ বছরের বনবাসের সময়েই পুরুষোত্তম হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, এসময়ই তিনি সামাজিক সংযুক্তিকরণের নীতি স্থির করেন। রামমন্দিরেও থাকবে এই বার্তা। যাতে গোটা দেশের মানুষ রামমন্দিরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেন। রামমন্দির নিয়ে ভাবাবেগকে ক্ষীণ করে মেরুকরণের রাজনীতি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।